শনিবার বেলা ৩টা। মোহাম্মদপুর থানার একটি গাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁশবাড়ি সড়কের দিকে আসছিল। পুলিশের গাড়ি থেকে সাইরেন বাজানোর শব্দ শুনে সড়কে থাকা মানুষগুলো নিমেষেই উধাও। চায়ের দোকানসহ অপ্রয়োজনে খোলা রাখা বিভিন্ন দোকানে দ্রুত শাটার নামানোর শব্দ শোনা গেলো। পুলিশ এসে দেখলো মূল সড়কে কোনও মানুষ নেই। দোকানপাটও সব বন্ধ। সবাই সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘরে থাকার নির্দেশনা মানছে। রাজধানীর অনেক স্থানেই দেখা যাচ্ছে এমন চিত্র।
বিভিন্ন হাউজিংয়ের ভেতরের গলিগুলোর চিত্রও ভিন্ন। কিছু দোকান অর্ধেক খোলা, কোনোটা পুরোপুরি। রাস্তায় সব বয়সের মানুষদের চলাফেরা। কোথাও কোথাও জটলা করে চলছে আড্ডা। গা ঘেঁষে বা কাঁধে হাত রেখে চলছেন অনেকে। যেখানে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হলে কমপক্ষে দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
যারা অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় ঘুরছেন, তারা রীতিমতো যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রশাসনের লোকজন চলে গেলে আবার যে যার মতো করে ঘুরছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। এ যেন কার্টুন সিরিজ ‘টম অ্যান্ড জেরি’র মতো অবস্থা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ চিত্রের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বশীলরা।
বিনা কারণে বাইরে ঘোরাফেরা করা এসব মানুষের প্রয়োজনে বের হওয়া নাগরিকরা নিজেদের নিরাপদ বোধ করছেন না। বিশেষ করে কাঁচাবাজারগুলোতে যাওয়ার পথে মানুষের ভিড় ঠেলে ঢুকতে হয় তাদের।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নয়ন হাওলাদার বলেন, আজ সাতদিন পর কিছু কাঁচাবাজার করতে বের হয়েছি। বাজারে ঢুকতে ভয় লাগছিল। কেউ নিরাপদ দূরত্বে থাকছে না। একেকটা দোকানে হুমড়ি খেয়ে বাজার করছে।
বাজারে আসার পথে সাধারণ মানুষের অযথা ঘুরাফেরা চোখে পড়ার মতো ছিল বলেও জানান নয়ন হাওলাদার। তিনি বলেন, আমি বাসা থেকে বের হয়ে বাজার পর্যন্ত আসতে অন্তত সাত-আটটা জটলা পেয়েছি। যারা বসে আড্ডা দিচ্ছে। কোথাও কোথাও দল বেঁধে ঘুরছে। পুলিশের গাড়ি দেখলে আড়ালে চলে যাচ্ছে। টম অ্যান্ড জেরির মতো আচরণ করছে। টমকে দেখে জেরি যেমন দৌড়ে পালায় বা লুকানোর চেষ্টা করে, পুলিশকে দেখেও অযথা ঘুরতে বের হওয়া মানুষগুলো এমন আচরণ করছে।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ বলেন, ‘আমরা টহল বাড়িয়েছি। কিন্তু কিছু মানুষ কোনও কারণ ছাড়াই বাইরে বের হচ্ছে। আমাদের গাড়ি দেখলে পালিয়ে যাচ্ছে। জনসাধারণকে নিজের স্বার্থেই ঘরে থাকতে হবে। আমরা বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক শ্রেণির মানুষ তা মানছে না।’
বস্তি এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষদের ঘরে রাখা অনেকটা চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ক্রমেই ঢাকায় করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুরুতে যে হারে মানুষ রাস্তায় বের হতো, এখন কিছুটা হলেও কমেছে। তবে নিম্ন আয়ের লোকজন যেসব এলাকায় বসবাস করে বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মানুষদের ঘরে রাখতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। লালবাগ, চকবাজার শহীদনগর, কামালবাগ, ইসলামবাগ, কামরাঙ্গিরচর এলাকাগুলো অনেক ঘনবসতিপূর্ণ। এসব এলাকায় মানুষ সন্ধ্যার পর একটু বের হতে চায়। আড্ডা দিতে চায়। বর্তমান গরম পরিস্থিতির কারণেও কিছু মানুষ রাস্তায় বের হচ্ছে। আমরা তাদের বুঝিয়ে ঘরে রাখার চেষ্টা করছি।
দিন এনে দিন খায় এমন মানুষদের খাবারের কষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছে ডিএমপির লালবাগ বিভাগের এই কর্মকর্তা। মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র মানুষজন সাহায্যের জন্য এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ভিড় করেন। সেসব স্থানে জমায়েত হয়ে যাচ্ছে। আমরা এসব জমায়েত বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের পক্ষ থেকে যেসব সহায়তা করা হচ্ছে, সেগুলো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। অন্য যারা সহযোগিতা করছেন, তাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
রাজধানীর উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকায় অযথা ঘোরাফেরা করা মানুষের সংখ্যা কমেছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির উত্তর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণখান জোন) হাফিজুর রহমান রিয়েল। তিনি বলেন, মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ছে। ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে হলেও মানুষ ঘরে থাকছে। অযথা বাইরে বের হওয়া মানুষের সংখ্যা কমছে। যারা বের হচ্ছে, তাদের কাছে জানতে চাচ্ছি, কেন বের হয়েছেন? যারা যথার্থ কারণ জানাতে পারছে না, তাদের কাউন্সেলিং করছি। অলিতে-গলিতে টহল বাড়িয়েছি। এতে করে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে ক্রমেই। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এই অবস্থার আরও উন্নতি করতে হবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষকে নিজ থেকেও সচেতন হতে হবে।
গুলশান এলাকায় মানুষকে ঘরে রাখতে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় সোসাইটির নেতারা কাজ করছে বলে জানিয়েছেন উপকমিশনার সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী। তিনি বলেন, এখন বাসিন্দারা বিভিন্ন সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত। সোসাইটির নেতারা বেশ একটিভলি কাজ করছেন। আমরা এসব সোসাইটির মাধ্যমে কাজ করছি। একেবারে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা কেউ বের হচ্ছেন না।
তবে ডিএমপির গুলশান বিভাগে বেশ কিছু বস্তি এলাকা রয়েছে। সেসব স্থানে মানুষকে ঘরে রাখাটা অন্যদের তুলনায় কষ্টকর বলে জানিয়েছেন গুলশান বিভাগের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বনানীসহ আশপাশের বস্তির মানুষদের সচেতন করতে আমাদের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কাজ করছে। মানুষদের সচেতন করা হচ্ছে। ভাইরাসের সংক্রমণ কীভাবে হয়, তাদের কতটুকু ঝুঁকি রয়েছে, তা বুঝিয়ে বলা হচ্ছে। তারপরও কিছু মানুষ বেরিয়ে আসছে। আমরা সেগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে যে নির্দেশনা জারি করেছে, আমরা তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করছি। মানুষকে ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করছি। বাজারসহ অন্যান্য জায়গায় যাতে জনসমাগম কম হয়, সবাই যাতে দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করে, সে ব্যাপারে আমাদের পুলিশ সদস্যরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। যারা সরকারের নির্দেশনা না মেনে কোনও কাজ ছাড়াই অযথা ঘোরাফেরা করছে, তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।

বার্তা বিভাগ প্রধান