চীনে (কভিড-১৯) করোনা ভাইরাসের উদ্ভবের পর তা ক্রমে ক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ায় এবং মানুষের মৃত্যু সংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকেই মন্তব্য করেছেন এটা একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই ঘটনা ঘটতে চলেছে। তা যদি এ রকম হয় তাহলে এ যুদ্ধ এক দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আরেক দেশের সেনাবাহিনীর গোলাবারুদ, বোমা-মিসাইল প্রভৃতি নিয়ে যুদ্ধ নয়, এ যুদ্ধ এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল মানুষের যুদ্ধ। এ অভূতপূর্ব যুদ্ধে কোনো ট্যাংকের চাকা ঘুরছে না, বোমারু বিমান উডছে না। বরং এ যুদ্ধে সকল দেশের যাবতীয় চাকা থেমে আছে। কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে পৃথিবীতে মানুষের অসহায়তা অতীতে এমনভাবে আর দেখা দেয় নি। অতীতে কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে পৃথিবীতে সকল রাষ্ট্রের মানুষ একত্রে এমন একত্ববোধে উজ্জীবিত আর কখনও হয়ে উঠেনি।
এ যুদ্ধ রাজনৈতিক নয়, এ যুদ্ধ ভু-প্রকৃতি-সম্পদ নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাতেরও নয়। এ যুদ্ধের বিষয় জনস্বাস্থ্যের এবং জনস্বাস্থ্যের সংকট নিয়ে। কাজে-কাজেই এ যুদ্ধের সৈনিক-সেনাপতির স্থান বদল ঘটতে বাধ্য । এ যুদ্ধের প্রকৃতি হবে জনযুদ্ধের মতো যাতে শুধু সৈনিক-সেনাপতিরা যুদ্ধ করবে না, যুদ্ধে অংশ নেবে জনগণও। যুদ্ধের ক্ষেত্রটির যেহেতু বদল ঘটেছে- যার সৈনিক-সেনাপতি হবে ডাক্তার-নার্সগণ এবং তার সাথে যুদ্ধে অংশ নেবে সর্বসাধারণ। যুদ্ধের ক্ষেত্র যখন জনস্বাস্থ্যের সেহেতু জনগণও এ যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন ও যোদ্ধা।
এ যুদ্ধের প্রতিপক্ষের নাম ভাইরাস, অতএব সবাই বলছি একটা রোগ। এ রোগ কলেরা-ডায়রিয়া, প্লেগ-বসন্ত-এর মতো কোনো রোগ নয়, যা ছিল স্থানিক মহামারী। এ কোভিড-১৯ ভাইরাস রোগের বৈশিষ্ট্য বৈশ্বিক এবং ক্ষিপ্র ও ধনী-দরিদ্র,জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মারমুখি। মানুষের বিরুদ্ধে এ রকম অপ্রতিরোধ্য সর্বসংহারক রোগের বা শত্রুর উদয় এ বিশ্বে অতীতে ঘটে নি। রাষ্ট্র- সকল মরিয়া হয়ে লড়ছে এ শত্রুর বিরুদ্ধে যা কিনা হানা দিয়েছে অতর্কিতে, চোরাগুপ্তায়। অতএব সকলেই লড়ছে অপ্রস্তুত থেকে, নিরস্ত্রভাবে, সেই ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের বাঙালির যুদ্ধের মতো।
কথিত চলমান বিশ্ব যুদ্ধের যোদ্ধার প্রকৃতি ও ক্ষেত্রের যেহেতু বদল ঘটেছে, আমরা নিশ্চয়ই দেখতে চাইবো সকল রাষ্ট্র সেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আগামীদিনে সবল যোদ্ধা (নার্স-ডাক্তার) ও সহযোদ্ধাদেরকে (জনগণকে) সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত করতে কি পরিমান অর্থ (বাজেট) বারদ্দ করে। বাংলাদেশ সরকার নিশ্চই আগামী বাজেটে আগামীদিনের জনপ্রতিরক্ষার (জনস্বাস্থ্য) গুরুত্ব ভেবে বাজেট বরাদ্দ অতীতের প্রতিরক্ষা বাজেটের অধিক বরাদ্দের গুরুত্ব দেবে। আলোচ্য যুদ্ধের ক্ষেত্রও প্রকৃতি যেহেতু জনস্বাস্থ্যের ও জনযুদ্ধের, অতএব বাংলাদেশের আগামী বাজেট বরাদ্দের চাহিদাও সর্বাচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হবে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের চিকিত্সা ব্যবস্থার দুরবস্থার মধ্যেও যা উন্নত ভাবা হয় তা ততো বেশি দামে কিনে নেবার পণ্য ছাড়া আর কিছু নয়। যার সুবিধা পাওয়া থেকে দেশের অধিকাংশ লোক বঞ্চিত। বর্তমান নোভেল-১৯ ভাইরাসে হানা দেবার পরিস্থিতিতে চিকিত্সা ব্যবস্থার আরো বেশি উন্নতির দাবি তোলা হবে নিশ্চয়ই। দেশের চিতিত্সা ব্যবস্থা যতো উন্নত হবে তার বাজার মূল্যও ততো বেড়ে যাবে সন্দেহ নেই। প্রচলিত নিয়মে সর্বসাধারণের তাতে প্রবেশাধিকার ততোই সংকোচিত হয়ে আসবে। এখনও উপজেলা পর্যায়ে সাধারণ মানুষ চিকিত্সা সেবা ঠিকমতো পায় না, সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিত্সা সেবার সুব্যবস্থাও নেই। জেলার অবস্থাও তথৈবচ। প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার-নার্স-সরঞ্জাম কোথাও নেই। বর্তমানে প্রাইভেট প্রাকটিসে কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বিষয়ে সবাই ওয়াকিবহাল আছেন। জেলায় সুনামধারী একজন ডাক্তার সন্ধ্যা ৫টা থেকে রাত ২টা অবধি শতশত রোগী দেখেন। এই ব্যবস্থা রোগীর জন্য যেমন ভালো কিছু নয়, একই সাথে ডাক্তারের জন্যও বিপজ্জনক। ভালো চিকিত্সা মানে সবকিছু ঢাকায় – এ ব্যবস্থা দূর না হলে এবং উপজেলায় এবং জেলার হাসপাতালে চিকিত্সা সুবিধা সুলভ ও সমৃদ্ধ না হলে কেন্দ্রে কিছু হাসপাতালে বিশেষায়িত চিকিত্সার উন্নয়ন ঘটলেও তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই থেকে যাবে। সাবেকী এই ব্যবসামুখি স্বাস্থ্যব্যবস্থা দিয়ে চলমান নতুন কথিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে জয় তো দূরের কথা কিছুতেই সামনে অগ্রসর হতে পারা যাবে না। এখন যে দুর্বল জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা যা কিনা অত্যন্ত ব্যবসামুখি, তা দিয়ে নতুনদিনের জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভবপর নয়।
কিউবার মতো সকল নাগরিকের জন্য চিকিত্সা ব্যবস্থা কিন্তু যা উন্নত ও সুলভ — ঐ পথে যাবার ভাবনা আমাদের রাষ্ট্রকে বর্তমান পরিস্থিতিতে (নতুন স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভাবনায়) ভাবতে হবে। চীনের কিংবা আমেরিকার বা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও তাদের সুসজ্জিত অস্ত্রশস্ত্র কোভিড-১৯ এর আক্রমনের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে নি। ওটা তার কাজও ছিল না। তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে লাগবে নাগরিকের স্বাস্থ্য সচেতনতার শিক্ষা, সুগঠিত, সুলভ ও পর্যাপ্ত (উপজেলা থেকে জেলা পর্যন্ত) স্বাস্থ্যসেবার উন্নত ব্যবস্থা যা অন্য দশটি মহার্ঘ পণ্যের মতো হবে না। অতএব রাষ্ট্রের বাজেটে প্রতিরক্ষার জন্য যে সিংহভাগ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় বর্তমান সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জনগণের স্বাস্থ্যব্যবস্থা খাতে বাজেট বরাদ্দ তাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে কিনা তা এখনই ভাবার বিষয় হয়ে উঠেছে।
জনস্বাস্থ্য সংকট কাটিয়ে উঠতে এবং জনগণকে সুস্বাস্থ্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও অভ্যস্থ করতে রাষ্ট্রের অনেক কিছুর আয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে। যার জন্য অনেক বেশি অর্থের যোগান প্রয়োজন হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষা কারিকুলামে জনস্বাস্থ্য বিষয়টি অতি আবশ্যক বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জনগণকে শিক্ষিত করার গুরুত্ব অপরিসীম। পুলিশি ব্যবস্থায় ঘরে ঘরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা দু:সাধ্য ব্যাপার যদি না এ বিষয়ে জনগণ শিক্ষিত হয়ে ওঠে। তবে পরিবেশ দূষিত না করতে জনগণকে আইনের কঠোরতার মধ্যে অবশ্যই আনতে হবে।
শেষ কথা হলো, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে স্বাস্থ্যসেবাকে বাজারের পণ্য আকারে হাজির করে নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে গণপ্রতিরক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে স্থাপন করে। জনযুদ্ধে জয়ের জন্য ঢেলে সাজাতে হবে জোরদার পাবলিক হেল্থ ব্যবস্থা এবং হাতিয়ার ও জ্ঞানে সুসজ্জিত আগামী দুনিয়ার সম্মুখ যোদ্ধা নার্স ও ডাক্তার বাহিনী তৈরি করে। তার জন্য দরকার রাষ্ট্রের আগামী বাজেটে সকল খাতের উপরে এবং গুরুত্বসহকারে স্বাস্থ্য খাতকে স্থান দেওয়া।
মকবুল আহমেদ, এনজিও কর্মকর্তা
নির্বাহী সম্পাদক