রফিকুল কবির ,প্যারিস থেকে :নভেল করোনা ভাইরাস তাবৎ মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ লকডাউন, টেস্ট, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, রিকভার/ডেথ প্রক্রিয়ায় নাগরিক সেবা দিচ্ছে। সবার মতো আমিও মানবিক অধিকারের এ সকল নিশ্চিয়তা নিয়ে ফ্রান্সে আমার বাসায় প্রথম ধাপ লকডাউনে আছি, সুস্থ্য আছি। আমি সুস্থ্য আছি এটা আমার আত্মীয়-স্বজন,বন্ধুবান্ধব,পরিবার সর্বোপরি দেশের সকলের জন্য স্বস্তির, আনন্দের। কিন্তু যখন আমি তাঁদের কথা চিন্তা করি তখন মাথা চক্কর দিয়ে উঠে! কারণ এখানে সরকার ও জনগণ কে কাকে কী বলে-কী করে, কী শুনে-কী বুঝে তা সুস্থ্য মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। মহামারী শুরুর প্রথম দিকে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বললো- ‘করোনা মোকাবেলার জন্য আমাদের দেশ অনেক উন্নত রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রস্তুত’, ‘পিপিই’র অভাব নেই’, ‘ডাক্তার,নার্স, হাসপাতাল যথেষ্ট’, ‘কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত,’ ‘খাদ্যের অভাব নেই’, ‘এ দেশে করোনা হতে পারে না’, ‘এটা ভয়ঙ্কর কোনো রোগ না’, ‘এ ভাইরাস গরমে মরে যাবে’ ইত্যাদি সব আজব কথাবার্তা। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের কেউ কেউ যখন দেশে ফিরল আমরা দেখতে পেলাম এয়ারপোর্টে স্ক্যানার নষ্ট, এর মধ্যে কয়েক লক্ষ মানুষ দেশে ঢুকে পড়েছে কোনো রকম চেকিং ছাড়া, আশকোনার হজক্যাম্প কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের নুংরা অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। দুএকজন করোনা আক্রান্ত ধরা পড়ার পর সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করার জন্য লকডাউন ঘোষণা করলো। সকল শিক্ষা প্রতিষ্টান, ধর্মীয় উপসনালয়, মিছিল মিটিং সহ সব ধরণের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করলো। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম প্রেসব্রিফিংএ মন্ত্রী মহোদয়ের পেছনেই গাদাগাদি গোটা চল্লিশেক লোক! ছুটি পেয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটে গেছে সাগর পারে! নির্বাচনী মিটিং মিছিল চললো অবলীলায়, মসজিদ মন্দিরে উপচে পড়া ভীড়! হাসপাতালে কয়েক বেডের ডায়াবেটিক শাখা উদ্ভোদনের জন্য নেতাকর্মীর ভীড়! ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সাথে ফ্লাইট বন্ধ করে দিলো তবু নিষেধ অমান্য করে কিছু ফ্লাইট আসলো। প্রবাসী ভাইরা এসে অনেকে কোয়ারেন্টাইন মানলোনা, ঘুরে বেড়াল। কেউ কেউ আবার ধুমধাম করে বিয়েও করলো! একী আজব কান্ড! সরকার ও জনগণ কে কাকে কী বলে-কী করে, কী শুনে-কী বুঝে – ভেবে ক্ষনে ক্ষনে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।
কোরোনার ভয়াবহতা রোধে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছুটি দেয়া হলো, ছুঠি দেয়া হলো যে যেখানে আছে সেখানে লকডাউন থাকার জন্য কিন্তু ছুটি পেয়ে শ্রমিকরা অমনি হুমড়ি খেয়ে লঞ্চ,বাস,ট্রেনে গাদাগাদি করে সবাই যার যার বাড়ি ফিরলো। গ্লাভস নেই, মাস্ক নেই, সামাজিক দূরুত্ব কিছুই মানা হলোনা। নাজানি কতজন কতজনকে সংক্রমিত করেছে! তারা নিশ্চয় বাড়ি ফিরে অন্য সদস্যদেরও আক্রান্ত করেছে! সরকার ১১ তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। সে কথা না শুনে গার্মেন্টস মালিকরা বললো ছুটি শেষ, ৫ তারিখ কাজে আসতে হবে। সুতরাং উপায় নেই, না ফিরলে কাজ থাকবে না আর! তাই মা-বাবা,স্বামী-স্ত্রী, সন্তানের শত বাধা উপেক্ষা করে সবাই ঢাকা মুখী আবার। দূরপাল্লার কোনো বাস নেই, ট্রেন নেই। সুতরাং পথ ভেঙে ভেঙে লোকাল গাড়িতে বা হেঁটে যে যেভাবে পারে সময়মতো পৌঁছে গেছে কারখানায়! এখন আবার ১৪ তারিখ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে, আবারো তারা হুড় হুড় করে যার যার বাড়ি যাচ্ছে। কী অমানবিক এই দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস হবেনা! কিন্তু কেন? কেন তারা বর্ধিত ছুটি কাটাতে পারলোনা? ফিরতেই হবে যখন কেন কোনো স্পেশাল বাস,ট্রেন,লঞ্চের ব্যবস্থা করলোনা? এঁরা গরিব বলেই এদের জীবনের কোনো দাম নেই। অথচ এঁরা চোরাকারবারি নয়, ঋণ খেলাপি নয়, শত শত কোটি টাকা ঘরের সিন্দুকে লুকিয়ে রাখা দুর্নীতিবাজ নয়। এঁরা হলো ‘The real fighter’ যারা দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে কাজ করে নিরলস। দুর্ভাগ্য তাঁদের সবসময় নিপীড়ণ, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। না, আমি বলছিনা এঁদের ঘরে বসিয়ে খাওয়াতে হবে। আমরা এও জানি শত শত কোটি টাকার অর্ডার পরে আছে সেগুলো করতে হবে, নাহয় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি শিল্প বিরুধী নোই, বরং একটি সুষ্ট নিরাপদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের কাজে লাগানোর কথা বলছি। সারা বিশ্বে পিপিই (মাস্ক,হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস, সুরক্ষা পোশাক, টেস্ট কিট, ইলেকট্রিক ফিভার ডিটেক্টর,ভেন্টিলেশন) ইত্যাদির চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে চাইনা হিমশিম খাচ্ছে। এমতাবস্তায় আমরা যদি আমাদের জনশক্তিকে এসকল উদ্পাদনে কাজে লাগাতে পারতাম তাহলে নিজেদের চাহিদা পূরণের সাথে সাথে রফতানি করে দেশের অর্থনীতি একটি অনন্য উচ্চতায় পৌছাতো আগামী ৬ মাসে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! আমাদের কথাতো কচু পাতার পানি, উনাদের কানে পৌঁছার আগে ঝরে পড়ে যায়।
গুণী শিল্পী অমর পালের একটি গান মনে পড়ে –
‘আমি কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়/ ওরে ভাইরে, ভাইরে
আমি কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।
দেখো ভালো জনে রইলো ভাঙা ঘরে/ মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে।
ও ভাই সোনার ফসল ফলায় যে তার/ দুইবেলা জুটেনা আহার,
হীরার খনির মজুর হয়ে কানাকড়ি নাই/ ও তার কানাকড়ি নাই।
ও ভাইরে, ও ভাই/ কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়…’
অমর পালের বিখ্যাত সেই গান আজও অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে দেশে নানা বিস্তৃত ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে কিন্তু জনগণের কিছু মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে সমভাবেই পিছিয়ে আছে, এবং আতঙ্কিতভাবে পশ্চাদপদ। এটা স্পষ্ট লক্ষ্য করি যে আমাদের দেশে উচ্চবিত্ত ও নিন্মবিত্তদের মধ্যে সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু আজ যেটা দেখছি সেটা মানবিকতার বড়ো বিপর্যয়। আইইডিসিআর সূত্র মতে দেশে করোনা আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা ৮৮, মৃত্যু ৯ হলেও পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখছি দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা সিনড্রোম নিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ! এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় মারা যাচ্ছে, কেউই রুগীদের ভর্তি নিচ্ছে না! সবচেয়ে অমানবিক হলো- পিপিই দেয়ার পরও ডাক্তাররা এসব রুগীকে চিকিৎসা দিচ্ছে না, কাছে পর্যন্ত আসছেনা! এটা অন্যায়। কারণ ডাক্তারদের অন্য কোনো পেশার মানুষ দিয়ে রিপ্লেস করা যায়না, উনাদের রিপ্লেসমেন্ট উনারাই! উনারা সাধারণ মানুষ নন, বরং সাধারণ মানুষের কাছে উনারা ভগৱান! খবরে দেখলাম চট্টগ্রাম মেডিক্যালে বড় ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পায়ে ধরলেও চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি! এভাবে ১৮ ঘন্টা পর তার ভাইয়ের মৃত্যু হয়! আমরা দেখছি সভ্য রাষ্ট্রগুলোতে যেসব রাজ্য করোনা আক্রান্ত নয় সেসব রাজ্যের
রফিকুল কবির ,প্যারিস, ফ্রান্স।
ডাক্তাররা স্বউদ্যগে আক্রান্ত রাজ্যে এসে রুগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন কিন্তু আমাদের দেশে এ কী হচ্ছে! ডাক্তাররা রুগীকে চিকিৎসা না দিয়ে বের করে দিচ্ছে! তাহলে এতদিন ডাক্তার,নার্স,হাসপাতালগুলোর এই প্রস্তুতির কথা শুনেছি! ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলছিলেন – বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন প্রায় রুগী শূন্য। কেন এই হাসপাতালগুলো ব্যবহার না করে শত শত কোটি টাকা খরচ করে অস্থায়ী হাসপাতাল করতে হবে? হ্যা, প্রয়োজনে করতে হবে, অপ্রয়োজনে নয়। আমি জেনে আঁতকে উঠলাম যে আমাদের দেশে প্রপার ভেন্টিলেশন করার মতো অভিজ্ঞ ডাক্তার নেই! তাহলে কেন চাইনা থেকে অভিজ্ঞ ডাক্তার এনে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না!
আমরা অল্পতেই মনে হয় দিশেহারা হয়ে গেছি। আমাদের সুস্থির পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কোরোনার বিরুদ্ধে জয়ের জন্য দল মত নির্বিশেষে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা আপদকালীন প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন,ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন। শুনা যাচ্ছে ত্রাণের বস্তাগুলোও কোনো কোনো নেতা (আপনারা চোর পড়বেন) আত্মস্বাত করে বাড়ি নিয়ে গেছেন। ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ছবি তুলে আবার ত্রাণ কেড়ে নিচ্ছে ! ত্রাণের কথা বলে গরিব মেয়েদের ধর্ষণ করছে। শারীরিক নির্যাতন করছে! এতো অপমানের চেয়ে করোনায় মৃত্যু শ্রেয়। আর সহ্য হয়না। একী আজব কান্ড! সরকার, সরকারের প্রশাসন, নেতাকর্মী, ডাক্তার এবং সাধারণ জনগণ কে কাকে- কী বলে-কী করে, কী শুনে-কী বুঝে – ভেবে ক্ষনে ক্ষনে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।
সব দেখি জগাখিচুড়ি।
রফিকুল কবির ,প্যারিস, ফ্রান্স।
নির্বাহী সম্পাদক