বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ। তিনি কারাবন্দী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে আছেন অনেক দিন। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলছে।
তাঁর চিকিৎসা ও শারীরিক অবস্থা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের দাবি, তিনি ভালো হাতেই আছেন। চিকিৎসকদের যা করণীয়, তা–ই করছেন। দেশসেরা চিকিৎসকেরা তো এ নিয়ে হেলাফেলা করবেন না। জানতে পারলাম, তাঁর জন্য যে মেডিকেল বোর্ড হয়েছে, তাঁর পছন্দের দুজন চিকিৎসক ওই বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে তাঁরাও খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করছেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা তাঁর জামিনের চেষ্টা করছেন অনেক দিন ধরে। শেষমেশ তাঁরা ‘মানবিক’ কারণে তাঁর জামিন চেয়েছেন। অর্থাৎ ধরেই নিয়েছেন, আদালত তাঁকে জামিন দেবেন না। বিএনপির নেতারাও সরকারের কাছে মানবিক কারণে তাঁর জামিন দাবি করছেন। তাঁদের দাবি, মামলাটি সাজানো। এটি একটি রাজনৈতিক মামলা। খালেদা জিয়ার স্বজনেরা তাঁর ‘মুক্তি’ চাইছেন। তাঁরা বলছেন, বাঁচাতে হলে তাঁকে বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
খালেদা জিয়ার জামিন, চিকিৎসা, শারীরিক অবস্থা এখন টক অব দ্য টাউন। আসল অবস্থা কী, এটা বোঝা মুশকিল। তবে এর মধ্যে যে অনেক গুমর আছে, তা টের পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, মামলা এ সরকার দেয়নি, এটি দিয়েছে এক-এগারোর সরকার। এ কথার অর্থ হলো, যে সরকারই মামলা দিক, এর মেরিট আছে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা মাঝেমধ্যে এক-এগারোর ‘কুশীলবদের’ প্রসঙ্গ টেনে হুংকার দেন। অথচ ওই সময়ের একটি মামলাকে তাঁরা পরম আদরে জিইয়ে রেখেছেন। কেন?
এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া নিজে কী ভাবছেন বা বলছেন, তা জানার উপায় নেই। দণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে কারাবন্দী অবস্থায় গণমাধ্যমে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে পারবেন না, এমন আইন করে গিয়েছেন মহারানি ভিক্টোরিয়া। এরপর আমরা দুবার স্বাধীন হলেও ওই আইন ছাড়া আমাদের চলে না।
প্যারোল বনাম জামিন নিয়ে বেশ কিছুদিন রশি–টানাটানি হলো। খালেদা প্যারোলে ছাড়া পান, এটা বিএনপি চায় না। প্যারোলে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত দেওয়া থাকে। প্যারোলের সময়সীমা কী হবে, সেটা নির্ধারণ করবে সরকার। ওই সময় তিনি যে কারণ দেখিয়ে প্যারোলের আবেদন করেছেন, এর বাইরে অন্য কোনো কাজে জড়িত হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে তাঁর একমাত্র কাজ হলো চিকিৎসা করা। অর্থাৎ তিনি প্যারোল নিয়ে দেশের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন, রাজনীতি করতে পারবেন না। প্যারোল দেওয়াটা সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক। তাহলে তাঁরা খালেদা জিয়াকে আপাতত রাজনৈতিকভাবে ছেঁটে ফেলতে পারবেন। এখানেই বিএনপির আপত্তি।
খালেদা জিয়া কোন অপরাধে কারাবন্দী এবং কেন জামিন পাচ্ছেন না, এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী দাবি শুনে হিমশিম খেতে হয়। কে সত্য বলছেন, আর কে বলছেন মিথ্যা? এখানে আরও কয়েকজন রাজনীতিবিদের মামলার প্রসঙ্গে টেনে আনা যায়। যেমন নাজমুল হুদা। তাঁর দণ্ড তো উচ্চ আদালতেও বহাল আছে। তাহলে তিনি কেমন করে জামিন পান?
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন একজন তারকাখ্যাতিসম্পন্ন ‘অপরাধী’, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ছিল। মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তিনি জামিনে ছিলেন। বলা যায়, ‘চিরস্থায়ী’ জামিনের যে উদাহরণ দেখা গেল তাঁর ব্যাপারে, এটি আমাদের বিচারিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন হলো, নাজমুল হুদা আর এরশাদ যদি জামিন পান, খালেদা জিয়া কেন পাবেন না? এখানেই সন্দেহের তির সরকারের দিকে তাক করা যায়। সরকারের সঙ্গে যে সমীকরণে এরশাদ-হুদারা জামিনে থাকেন, খালেদার সঙ্গে তো সেই সমীকরণ নেই। বিষয়টা যে রাজনীতির রসায়নের সঙ্গে যুক্ত, এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।
আওয়ামী লীগ সরকার এত দিনে খালেদা জিয়াকে বাগে পেয়েছে। ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট—এসবের সুদেমূলে হিসাব নেওয়ার সুযোগ এসেছে। এই গ্যাঁড়াকল থেকে ছাড়া পেতে হলে সরকারের সঙ্গে একটা বন্দোবস্তে যেতে হবে। বিএনপি যেহেতু সরকারকে বড় কোনো চাপে রাখতে পারছে না, একটা লেনদেনে তাকে আসতে হবে। এ জন্য সরকার যে দাম হাঁকছে, তা অনেক বেশি, বিএনপির পক্ষে হজম করা কঠিন। এত দিন আওয়ামী নেতারা তারস্বরে বলেছেন, ‘খালেদা এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন।’ খালেদা প্যারোলে সম্মত হলে তাঁরা গাইবেন নতুন গীত—‘দ্যাখো, বিএনপি কেমন আত্মসমর্পণ করল, আর আমরা কেমন দয়া দেখিয়েছি।’
শেষমেশ এটা না–ও হতে পারে। শুনেছি, খালেদা জিয়া খুবই ‘স্টাবর্ন’—একগুঁয়ে। ভাঙেন, তবু মচকান না। যদি একবার মচকান, তাঁর রাজনীতি শেষ। ‘আপসহীন’ খালেদা কি এভাবে রাজনৈতিক ‘আত্মহত্যা’ করবেন? নাকি এ–ই ছিল তাঁর নিয়তি—মুচলেকায় মুক্তি। সুত্র: প্রথম আলো
মহিউদ্দিন আহমদ
লেখক ও গবেষক
প্রতিনিধি