আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। ওয়াস্সালাতু ওয়াস্সালামু আলা রাসূলিহিল কারিম।
মহান আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহে আমার শ্রদ্ধেয় উস্তাদ কবি এম এ বাছিত আশরাফ সাহেবের সদ্য প্রকাশিত ইসলামিসংগীতের এক অনন্য সমাহার “মরুর বুকে আলোর নহর” গ্রন্থটি পড়তে পেরেছি।
কবি, মাওলানা এম এ বাছিত আশরাফ সাহেব আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে বিগত দেড়যুগের বেশী সময়কাল ধরে সাহিত্য সাধনায়রত। আমাদের জাতি–সত্ত্বার বিকাশ ও উজ্জীবনের লক্ষ্যে সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে লিখছেন তিনি।
লেখক একজন আশিকে রাসূল। তিনি নিবেদিত চিত্ত এবং প্রেম–ভালোবাসা, আবেগাপ্লুত ও সন্ধানীর দৃষ্টিতে “মরুর বুকেআলোর নহর ” গ্রন্থটিতে মহান আল্লাহর সু–মহান শানে চমৎকার হামদ ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিঅকৃত্রিম ভক্তি–ভালোবাসায় সিক্ত অনেকগুলো না‘ত শরীফ এবং ঘুমন্ত বিবেকের দরজায় ঈমানী জযবার ঠকঠক আওয়াজ ওসমসাময়িক বিষয়াবলীর উপর প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও প্রতিহতের জাগরণী ডাক দিয়ে বৈচিত্র্যময় ও ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতেচেষ্টা করেছেন আল্লাহ প্রদত্ত তাঁর কিছু কলমী শক্তি।
গ্রন্থটি শুরু করেছেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের স্তুতি বা প্রশংসা দিয়ে। “পাখিরা ডানা মেলে ” শিরোনামের এইসংগীতটিতে তুলে ধরেছেন আমাদের চারপাশে সৃজিত মহান আল্লাহর অপার সৌন্দর্য ও সৃষ্টির কথা। উপস্থাপন করেছেন পাখি, মৌমাছি, নীল আকাশের রংধনু, চাঁদ–তারা, ফুলে–ফলে ভরা অবারিত সবুজ কানন, সাগর–নদী–মরুভূমিসহ সবই যে মহানআল্লাহর হুকুমে চলছে ও নিরবে–নিভৃতে গেয়েই যাচ্ছে লা–ইলাহা ইল্লাল্লাহর গান তার কথা! কবি বলেছেন—
“পাখিরা ডানা মেলে দূরে উড়ে যায়
মৌমাছি মৌচাকে মধু খুঁজে পায়
কার ইশারায়!!”
তাছাড়া গ্রন্থটির প্রথম অধিবেশনে যুক্ত করেছেন ” বিসমিল্লাহ, তোমায় খুঁজি, আল্লাহু আকবার, অনুভব, ফুলের সুবাস, তাসবিহজপি, দয়াল মালিক ও গগন ভরা সূর্য তারাসহ” প্রায় ২১টি হামদে বারি তায়ালা।
এগুলোর মধ্যে “গগন ভরা সূর্য তারা” শিরোনামের হামদটি সকল আমিত্বকে ভুলে মহান আল্লাহর শাহানশাহী দরবারে এলাহিতেনিজেকে নত ও সঁপে দিয়ে কুর্নিশ করতে শেখায়! কবি বলেছেন—
“গগন ভরা সূর্য তারা গাহে তব গান
তাহারি এক কোণে আমি পেয়েছি যে স্থান
আল্লাহ অসীম তোমার শান“।।
এই হামদে বারি তায়ালাটি গেয়েছেন শিল্পী সুহেল আহমদ। অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠে ও সুরে হামদটিকে তিনি আরও প্রাঞ্জল করেতুলেছেন। ইউটিউবে শিরোনাম লিখে সার্চ দিলেই যেকেউ হামদটি শুনতে পারবেন।
শানে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে তো এক সীমাহীন পারাবার। এই অথৈ দরিয়ায় কতোভাবে যে অবগাহন করাযেতে পারে এবং এই রত্ন খনিতে মণি–মুক্তা, হীরা–জহরতের চেয়েও যে অধিক মূল্যবান পরশমণি রয়েছে, লেখক তাঁর প্রেমাস্পদহৃদয়, আবেগাপ্লুত মননশীলতা, জ্ঞানের প্রখরতা, ভালোবাসা–শ্রদ্ধা ও সর্বোচ্চ ভক্তিপূর্ণ ভাষা, শব্দ, বাক্য ও উপমা দিয়ে “মরুরবুকে আলোর নহর” গ্রন্থটির নাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধ্যায়টিকে প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রয়াসপেয়েছেন। তাই আমি এই লেখাটির শিরোনাম দিয়েছি—
“মরুর বুকে আলোর নহর;
মলাটবদ্ধ প্রেমের শহর“!!
লেখক গেল বছরে মহান আল্লাহর অপার করুণায় হারামাইনের মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। কা‘বায় তাওয়াফ ওজিয়ারতে রাওদ্বায়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করে ধন্য হন। মদিনায় অবস্থানকালে ফজরের সালাত শেষে বাহিরেএসে দেখেন একপাল পাখি মদিনার আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। পাখিদের দেখে তিনি “ভোরের আকাশে চাঁদ উঠেছে” শিরোনামেএকটি নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখে নিজের মনেরভাব ব্যক্ত করেন।
শিরোনামটি পড়ে যেকেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, ভোরের আকাশে ত সূর্য ওঠে তাহলে লেখক চাঁদ উঠেছে বললেন কেন? এ প্রশ্নআমারও মনে উদ্রেক করেছিল কিন্তু বেশিক্ষণ থাকেনি। না‘তটি পড়ে দেখলাম এ চাঁদ আকাশে প্রতিরাতে উঠা আর ডুবে যাওয়াচাঁদ নয়; এ চাঁদ জিয়ারাতে রাওদ্বায়ে আত্বহার! এ চাঁদ হুব্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাঁদ। আর প্রেমেরআলাপনে চাঁদনিরাতই মধুর সময়। চাঁদের কোমল আলো প্রেমের পরশ বুলায় তাই প্রেমিকেরা প্রেমের অনুভূতিতে চাঁদকে টানে।ভোরের আকাশ কবির মন, হৃদয়, অন্তর–অস্থিত্ব ও জীবনের প্রারম্ভাংশ অর্থাৎ নূরের মদিনায় গিয়ে যেন কবির জীবনের নতুনঅধ্যায় শুরু হলো। আকাশে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক দেখে কবির মন চলে গেলো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেররাওদ্বায়ে আতরের কিনারে থাকা আশিকে রাসূলদের দিকে। তাঁরাও যেন গম্বুদে খাজরার পাশে ওই পাখিদের মতো কুহু কুহু করেবলছে “আস্সালতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ“, লাব্বাইক, লাব্বাইক ইয়া হাবিবাল্লাহ“। তাই কবি বলেছেন—
” ভোর আকাশে চাঁদ উঠেছে নূরের মদিনায়
পাখি ডাকে কুহু কুহু গম্বুদে খাজরায়।।
রওদ্বা পাশে স্বপ্ন বুনি
হতাম যদি চাঁদ
রাত জেগে দেখতাম তোমায়
মিটতো মনের স্বাদ
দু–চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে
দীদারের আশায়“।।
এই না‘তটি খুবই মনোমুগ্ধকর ও আবেগাপ্লুত সুরে গেয়েছেন শিল্পী সুহাইল আহমদ। শিল্পীর কণ্ঠের মধুমাখা সুরের মূর্ছনায় উক্তনা‘তটি আশিকে রাসূলদের অন্তরে প্রেমের তরঙ্গ বইয়ে যাচ্ছে। ইউটিউবে শিরোনাম লিখে সার্চ দিয়ে একবার শুনলেই অন্তরেনূরের মদিনার পাখি হবার সাধ জাগবে ইনশাআল্লাহ..!
উক্ত অধ্যায়ে আছে, “কেঁদে কেঁদে যদি আঁখি চলে যায়, বালাগাল উলা বিকামালিহি, তোমারই প্রেমে, ইয়া নবী মুহাম্মদ, ইয়া নবীসালামসহ প্রায় ৪২টির মতো প্রেমোসিক্ত নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তার মধ্যে আছে সবুজকুঁড়ি শিল্পীদের পরিবেশিত “তোমারই প্রেমে” শিরোনামের চমৎকার একটি নাতে রাসূল। না‘তটিতে প্রকাশপেয়েছে প্রিয় নবীর প্রতি কবির প্রেম–ভালোবাসা আর আবেগের কথা। দিদারে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যঅশ্রুভেজা ফরিয়াদের কথা। কবি বলেছেন—
” ওগো, তোমারই প্রেমে আঁখি অশ্রু ঝরায়
নীল আকাশে চাঁদের আলো জোছনা ছড়ায়“!!
না’তটির পরের অংশগুলোতে কবি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেমের ফোয়ারা বইয়ে দিয়েছেন। না’তটি ইউটিউবে সবুজকুঁড়ির অফিসিয়াল চ্যানেলে গিয়ে শিল্পী সুলতান আহমদের ও একজন ক্ষুদে শিল্পীর যৌথ পরিবেশনায় শুনলে কলিজা জুড়িয়ে যাবে। নবীজীর মহব্বতে হৃদয় বিগলিত হবে। চোখ অশ্রুসিক্ত হবে ইনশাআল্লাহ..!
গ্রন্থটির তৃতীয় অধিবেশন সাজিয়েছেন প্রার্থনামূলক, মুর্শিদ বন্দনা ও দেশাত্মবোধক কিছু জাগরণী সংগীত দিয়ে।
প্রার্থনামূলক অনেকগুলো সংগীতের মধ্যে একটি সংগীত হলো “মিনতি”। এই সংগীতটিতে যে প্রার্থনা কবি করেছেন তা পৃথিবীর সকল মুমিন মুসলমানের প্রার্থনা হওয়া উচিত। কারণ, একজন মুমিন-মুসলমানের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো তার ঈমান। আর এ ঈমানকে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। ঈমানকে শক্ত ও মজবুত রাখতে হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেম ভালোবাসা ছাড়া ঈমানের উপর অটল থাকা অসম্ভব। আর নবীজীর প্রেম থেকে মানুষকে কীভাবে দূরে রাখা যায় তার ফন্দি এঁটে যাচ্ছে কিছু মুসলিম নামধারী মুনাফিক চক্র। এদের বক্রতা ও কুচক্রীতার মহল দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই মরণ পর্যন্ত ঈমানকে এদের থেকে রক্ষা করতে নবী প্রেমের বীজ হৃদয়ে বপন করতেই হবে। আর হুব্বে রাসূল অর্জনে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করতে হবে। তাই কবি বলেছেন—
” তোমার নবীর প্রেমে আমার মরণ যেন হয়
তোমার কাছে এই মিনতি ওগো দয়াময়!!
প্রতিদিন ঈমান নিয়ে মুখোমুখি হই
মুনাফিক প্রলোভনে করে হইচই
গোমরাহি সুর তুলে করে মোহময়।।
উক্ত সংগীতটিতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন বিশ্ব নন্দিত কণ্ঠ শিল্পী, সময়ের শ্রেষ্ঠ কলম সৈনিক, অসংখ্য-অগনিত ইসলামি সংগীতের জনক, কবি মুজাহিদুল ইসলাম বুলবুল। তাঁর কণ্ঠের স্পর্শে “মিনতি” পেয়েছে ভুবনমোহিনী এক সুর। পাথর হৃদয়কেও গলিয়ে দেওয়ার মতো পেয়েছে এক অসাধারণ স্পৃহা। ইউটিউবে রিসালাহ এর অফিসিয়াল চ্যানেলে সংগীতটি শুনতে পারবেন।
জাগরণী সংগীতের মধ্যে রয়েছে “আদালতে মূর্তি কেন, ঈমানী আগুন, মুক্ত করবো আরাকান, আজ বড় প্রয়োজন, হে খোদা পূর্ণ কর ও কেন-সহ আরো বেশ কয়কটি চমৎকার সংগীত।
আছে ” বাবা” শিরোনামে কবির মরহুম বাবাকে স্মরণ করে একটি হৃদয়স্পর্শী সংগীত। সংগীতটিতে কবি পৃথিবীর সকল বাবা হারা এতিমের কান্নাকে তুলে ধরেছেন।
মুর্শিদ বন্দনায় রয়েছে ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে ও তেলিকোনার মুফতি ছাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে নিবেদিত কয়েকটি মর্সিয়া।
দেশপ্রেম বুকে ধারণ করে কবি এই গ্রন্থটিতে স্থান দিয়েছেন মনোমুগ্ধকর কিছু দেশাত্মবোধক সংগীতের। “বাংলাদেশ” শিরোনামের সংগীতটিতে কবি তুলে ধরেছেন এদেশের প্রকৃতি, মাটি ও মায়ের কথা। যাঁদের রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এদেশ তুলে ধরেছেন সেসব মহান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। তুলে ধরেছেন এদেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীনকারী মহা মনীষী হযরতে শাহ্ জালাল, শাহ্ পরাণ, ৩৬০ আউলিয়া ও আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ সকল আলিম-উলামা, পীর-মাশায়েখের কথা।
পরিশেষে বলি “মরুর বুকে আলোর নহর” গ্রন্থটি পাঠ করে আমি পেয়েছি হামদ, নাত, জাগরণী সংগীতের মাধ্যমে এক অমিয় স্বাদ। পেয়েছি হৃদয়ে এক অনাবিল প্রশান্তি।
প্রিয় সংগীত প্রেমীবৃন্দ! আশা করি আপনারা এ গ্রন্থটি পাঠ করে উপকৃত হবেন। পাবেন আপনাদের কণ্ঠ ও সুরের ঝংকার তুলার এক বিশাল উপকরণ।
মহান আল্লাহ তায়ালা লেখকের এই শ্রম ও প্রয়াসটুকু কবুল করুন– এটাই হৃদয়ের মোনাজাত। আমীন! ইয়া রাব্বাল আলামিন।
বই পরিচিতি:
মরুর বুকে আলোর নহর
লেখক: এম এ বাসিত আশরাফ (M A Basit Ashraf)
প্রকাশনী: ঘাস প্রকাশন, মাছুদিঘির পাড়, সিলেট
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০ টাকা
যোগাযোগ: 01711-336407