গতানুগতিক পড়াশোনা ও প্রোগ্রামিং ভালো লাগেনি মর্তুজা আজমের। তার বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ার আলতা গ্রামে। চার ভাই, বাবা-মাকে নিয়ে সংসার। বাবা শিক্ষক ছিলেন। আর মা গৃহিণী। বিআইইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষে পড়েছেন বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে।
ডিপ্লোমা শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য পড়েছেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগোর উইলিস টাওয়ারে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের সিনিয়র সাইবার সিকিউরিটি অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ার। তার সঙ্গে কথা বলে ছোটোবেলা, বেড়ে ওঠা ও সফলতার গল্প জানাচ্ছেন আফতাবুল ইসলাম শোভন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় মর্মাহত হন মর্তুজা আজম। এ ঘটনায় গভর্নর আতিউর রহমান এতো ভালো মানুষ হয়েও তাকে চাকরিটা হারাতে হয়েছে। তখনই ভাবনার শুরু। ঠিক করে ফেললেন সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করবেন। পড়শোনা শেষে তিনি ঠিকই সাইরবার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন।
এখন তিনি সাইবার সিকিউরিটি প্রদান করছেন ম্যানহাটান বোরো প্রেসিডেন্ট অফিস, আমেরিকার ন্যাশনাল ব্রোডকাস্টিং কোম্পানি তথা ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্ট জায়ান্ট এনবিসি ইউনিভার্সালে (NBC Universal)। আমেরিকায় বসেও বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার জন্য কাজ করছেন। এরইমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, এক্সেস টু ইনফরমেশনের এডভাইজার, প্ল্যানিং মিনিস্টারসহ উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কনফারেন্স ও মিটিং অব্যাহত রেখেছেন।
মর্তুজা আজম বলেন, যখন এসএসসি পরীক্ষা দিবো তখন টাইফয়েড হয়। এসএসসিতে ভালো করতে পারিনি। বরিশাল পলিটেকনিকে ভর্তির পর সব পাল্টে যায়। শুরু থেকেই ফলাফল ভালো করতে থাকি। সবসময় প্রথম হয়েছিলাম। একজন সফল মুর্তজা আজমের পেছনের গল্পগুলো তিক্ততা ও বেদনায় ভরা। তবে তিনি এই কষ্টের দিন ভুলে প্রাণচঞ্চল তার দিনগুলোকে অতিবাহিত করেছেন।
তিনি কলেজ জীবনের স্মৃতি টেনে বলেন, কলেজের শেষ বর্ষে যখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট হয়। ডিপার্টমেন্টের হেড স্যার চাইলেন তার পছন্দের কোম্পানিতে যেন ট্রেনিং করি। আমার ইচ্ছে গাজীপুরে ট্রেনিং করবো। ডুয়েটে ভর্তির জন্য কোচিং করব। কিন্তু নাছোরবান্দা। কিছুতেই আমাকে ছাড়তে নারাজ। একদিন স্যারের রুমে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। একপর্যায়ে মাথা ঝিমিয়ে ধরলো। তখন স্যার বললো, আজম তোমাকে আর কান্না করতে হবে না, তুমি যেখানে ট্রেনিং করতে চাও সেখানেই করতে পারবে।
তখন ডুয়েটে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি। গাজীপুরে থাকি। ডুয়েটের ভেতর বিভিন্ন প্রোগ্রাম হত। তখন সিনিয়র ভাইয়েরা বিভিন্ন প্রোগ্রামের প্রেজেন্টার ছিল। তখন বন্ধুদের বলতাম। ডুয়েটে যখন চান্স পাবো তখন আমিই এসব অনুষ্ঠানের প্রেজেন্টার হব। সত্যি সত্যি তাই হলো। চান্স পেয়েছি ডুয়েটে। এরপর থেকে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের প্রেজেন্টার ছিলাম।
একদিন সেকেন্ড ইয়ারের ভাইদের সঙ্গে ক্লাস করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারা ক্লাস করতে দেয়নি। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এসময় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ভাইয়েরা বললো, আজম তুমি এখানে কি করো? আমি বললাম, ক্লাস করতে আসছিলাম কিন্তু তারা ক্লাস করতে দেয়নি। তারা বলল, কি বলো তোমাকে ক্লাস করতে দেয়নি। চলো আমাদের সঙ্গে ক্লাস করবা। কি সৌভাগ্য আমার আমি ভর্তি হওয়ার আগেই ফাইনাল ইয়ারের ভাইদের সঙ্গে ক্লাস করলাম।
আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছিলাম তখন বিশ্ববিদ্যালয় একটি ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার হয় সেখানে মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তাদের সঙ্গে একমাত্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র প্রতিযোগিতা করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতে চেয়েছিলাম আবৃত্তি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সিনিয়ররা সে সুযোগটা সহজে দিতে চাইতো না। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাকে যে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না সেটা ডক্টর নাসিম স্যারের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি একদিন বলেই ফেলেন যে তেলকে যতই পানির নিচে রাখ না কেন তেল একদিন উপরে উঠবেই। স্যারের সেই দিনের সেই কথাগুলো এখনো আমার মনে পড়ে।
তার গতানুগতিক পড়াশোনা ভালো লাগত না তার যেটা ভালো লাগতো তাই করতো এমন পরিস্থিতিতে টিচারদের অনেক বকা ঝকা খেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি তার লক্ষ্যে অটুট ছিলেন। একদিন একজন শিক্ষক তাকে বলেন, এই আজম তুমি কিন্তু এক্সট্রা কারিকুলাম নিয়ে বেশি সময় দিচ্ছো। এক্সট্রা নায়ক কিন্তু নায়ক হতে পারে না। তখন তিনি বলেন, স্যার দেখি না কতদূর যেতে পারি।
তিনি বলেন, সেদিনের আত্মাবিশ্বাসই আজ সত্য। এই এক্সট্রা কারিকুলাম আমাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে। এক্সট্রা কারিকুলাম বলতে বোঝায় যেটা ভালো লাগে সেটাই করা। আমেরিকায় একটি প্রজেক্টের সার্টিফিকেশন করতে ৬০ দিন লাগে। কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল ভালো লাগতো তাই সেটি ১২ দিনে শেষ করি। গুগলের একটি প্রজেক্ট করতে আট মাস সময় লাগে কিন্তু আমার আগ্রহ থাকায় সেটি আমি দেড় মাসে কমপ্লিট করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রেজেন্টেশন ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট হয়। প্রেজেন্টেশন শেষের দিকে বিকেল হয়ে যেত। স্যাররা আমাকে যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছেন। যেন আমি প্রেজেন্টেশনটা সকালের দিকে শেষ করতে পারি। কেন না সেই রাতে আমার আমেরিকা যাবার ফ্লাইট ছিল।
তিনি স্যারদের অনেক ধন্যবাদ জানান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পরের দিন ১০ আগস্ট সেখানে একটি প্রোগ্রামের যোগদান করার কথা ছিল। এই ছোট জীবনে চলার পথে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। হোঁচট খেতে হয়েছে বারবার। জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক সময় ড্রাইভার হয়ে কাজ করতে হয়েছে হেলথকেয়ার এ কাজ করতে হয়েছে এমনকি হকারি করতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষকের কাছে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। প্রথম কোনো স্টুডেন্ট হিসেবে ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করি। চার বছরের শিক্ষা জীবনে ডুয়েটের তিনটি ইউনিভার্সিটি এনিভার্সারি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত অন্য কাউকে দিয়েছেন বলে মনে হয় না। তিনি আমেরিকা যাওয়ার পরও অনুষ্ঠান উপস্থাপক হিসেবে নাম দেয়া হয় বিষয়টি তখন তৎকালীন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক প্রফেসর ড. কামরুজ্জামান স্যারকে জানানো হয় যে তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন।
সিআর হিসেবে যেমন তাকে সবাই চিনতো তেমনি উপস্থাপক হিসেবেও। ডুয়েট এবং ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়ার মধ্যকার কলাবোরেটিভ সেমিনারের মডারেটর ছিলেন তিনি। ডুয়েট ও ইউজিসির মধ্যকার কনফারেন্সেরও উপস্থাপক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি সবার আস্থা অর্জন করেছিলেন বলেই হয়তো তাকে এসব দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। স্যারদের আন্তরিকতা না থাকলে হয়তো এটা হয়তো সম্ভব হতো না বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, রেজিস্ট্রার ড.আসাদুজ্জামান চৌধুরী তৎকালীন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. কামরুজ্জামানসহ ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ছাত্রজীবনে ভিসির বাসভবনে গেস্ট হয়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেটি হয়ে ওঠেনি। তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাকে তার বাসভবনে ইনভাইট করেন। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, এই ইচ্ছেটাও এবার আমার পূরণ হয়ে গেল। এটা শিক্ষার্থীর জীবনে অনেক বড় পাওয়া।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নিয়মের পরিবর্তন হওয়া দরকার। ছাত্ররা ক্লাসে নিজের মত করে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করত না। বেশিরভাগ ছাত্রই কপি-পেস্ট অভ্যস্ত। তিনি এই সব নিয়ম নীতি থেকে ছাত্রদের বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। এছাড়াও তিনি শিক্ষক নিয়োগের বেলায় সিজিপিএ দেখে শিক্ষক নিয়োগের পক্ষে নন।
তিনি বলেন, দানব কখনো মানব হতে পারে না। তাই তিনি শুধু সিজিপিএ নয় শিক্ষক নিয়োগের বেলায় যেন অন্যান্য বিষয়গুলো গুরুত্বের সহিত দেখা হয় সেই আহ্বান জানান। বিশেষ করে একজন শিক্ষক যেন মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হয় এই আশা ব্যক্ত করেন।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মর্তুজা আজম ছিলেন মেধা তালিকায় প্রথমস্থান অধিকারী। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বিএসআইটি ও বাংলাদেশ পুলিশের ইনফরমেশন টেকনোলজির ট্রেইনার ছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক ও সংবাদপাঠক, বাংলাদেশ টেলিভিশনের আবৃত্তিকার ও ডকুমেন্টারীর ভয়েস আর্টিস্ট, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার ইন্টার্ন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক্সেস টু ইনফরমেশনের একজন সফল ইন্টার্ন ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অ্যাসেম্বলিতে ইয়াং লিডার হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন এবং প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে ইউনাইটেড স্টেটের সিনেটে বক্তব্যও রাখেন তিনি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে অর্জন করেন গ্রাডুয়েশন ও প্রোমাস্টারের স্বীকৃতি। বিভিন্ন ধরণের মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতা, জাতিসংঘের গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর অ্যাওয়ার্ড তথা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স বেস্ট অ্যাওয়ার্ডসহ প্রায় ৭০টিরও বেশি পুরস্কার ও ক্রেস্ট পান তিনি।
তিনি বলেন, দেশ আমাদের অনেক অনেক কিছু দিয়েছে আমরা দেশকে কিছুই দিতে পারেনি আমি একটা বিষয়ে সব সময় অনুভব করি আজকের বাংলাদেশকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে হলে দরকার আদর্শবান আর সৎ ও দক্ষ নেতৃত্ব। হ্যাঁ হয়তো কোন একদিন একজন আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে দাদা ও বাবার মতো নিজেকে দেখতে চাই আর এপিজে আবদুল কালামের মতো দেশকে সৎ ও নিষ্ঠাবান একজন নেতা হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দিতে চাই। যদি বাংলাদেশে কোন একদিন ফিরে আসি দেশের জন্য কাজ করতে চাই। দেশকে গড়ে তুলতে দেশের জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। ডেইলি-বাংলাদেশ ডটকম
প্রতিনিধি