Home » স্বচ্ছ নেতৃত্বের প্রত্যাশা

স্বচ্ছ নেতৃত্বের প্রত্যাশা

সম্মেলনকে ব্যতিক্রমী ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন দলটির তৃণমূল নেতারা। তাদের প্রত্যাশা, এ সম্মেলনের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ নবরূপে গড়ে উঠবে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানের পথ ধরে শুরু হবে অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার এক নবতর যাত্রা। এর নেতৃত্ব দিতে আওয়ামী লীগকে সৎ, ত্যাগী, পরিচ্ছন্ন নেতাদের নিয়ে নতুন করে সাজানো হবে। গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে আগত তৃণমূল নেতারা এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।

জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল আমাদের সময়কে বলেন, দলের পরীক্ষিত নেতাদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আনা হবে এ প্রত্যাশা করি। নেত্রী শেখ হাসিনা অতীতে কখনো নেতা নির্বাচনে ভুল করেননি, কর্মীরা কী চান তা তিনি বুঝেই সব সময় নেতৃত্ব নির্বাচন করেছেন, এবারও তাই করবেন।

বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের নেত্রী সোহেলী পারভেজ ছবি বলেন, ‘সাধারণ সম্পাদক পদে কে আসছেন, সেই নাম বলতে চাই না। নেত্রী যাকে ঠিক করে দেবেন, তিনি আসবেন। আর তিনি ঠিক করে না দিলে ভোটের মাধ্যমে একজনকে নির্বাচিত করব আমরা।’

বিভিন্ন জেলা থেকে আগত কাউন্সিলররা প্রায় অভিন্ন সুরে আমাদের সময়কে বলেন, এবারের সম্মেলন ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক বেশি। যেহেতু নেত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন, সে জায়গা থেকে আমাদের পিছু ফেরার সুযোগ নেই।

গতকাল বেলা ৩টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২১তম ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেন দলটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন তিনি। সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন পেশ করেন ওবায়দুল কাদের। এর আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠ ও শোক প্রস্তাব পাঠ করা হয়।

সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে ওবায়দুল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর তারই কন্যা শেখ হাসিনা সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছেন। গত ৪৪ বছরে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার নাম শেখ হাসিনা। তিনি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দেশকে গড়ে তোলার কাজ করেছেন। কোন্দলে জর্জরিত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং আন্দোলনের মাধ্যমে শৃঙ্খলিত গণতন্ত্রকে মুক্ত করেছেন।

তিনি বলেন, জাতির জনককে হত্যার পর দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেই অবস্থা থেকে দেশকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসতে কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণে গত ৪৪ বছরে সবচেয়ে সাহসী রাজনীতিকের নাম, দক্ষ প্রশাসকের নাম, সবচেয়ে সফল কূটনীতিকের নাম, জনপ্রিয় নেতার নাম শেখ হাসিনা।

এ সময় দলীয় প্রধানের চিন্তা ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশে থাকার আহ্বান জানান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করছেন। তাই আজ তার নেতৃত্বে যে শুদ্ধি অভিযানের শুরু হয়েছে, তার মাধ্যমে আমাদের শুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য নিজেদের গড়ে তুলতে হবে, এটিই হোক আজকের অঙ্গীকার।

সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলেও যোগ দেয়নি বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট। উপস্থিত ছিলেন ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের সভাপতি মিসবাহুর রহমান, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রমুখ। বিকল্প ধারার মহাসচিব মান্নানকেও সম্মেলনে দেখা গেছে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, এসএম ফয়সল চিশতি, মুজিবুল হক চুন্নু, রানা মোহাম্মদ সোহেল ও সুনীল শুভ রায় যোগ দেন। এ ছাড়াও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুরও সম্মেলনে যোগ দেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী তানজীম আহমেদ সোহেল তাজও উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলন ঘিরে সকাল থেকেই জনারণ্যে পরিণত হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন এলাকা। দেশের নানা অঞ্চল থেকে নানা সাজে জমায়েত হন নেতাকর্মীরা। মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগ পর্যন্ত পুরো এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এ এলাকায় যান চলাচল সীমিত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ৮১ সদস্যই থাকছে। সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনাই পুনর্নির্বাচিত হবেন। যত কৌতূহল ও আলোচনা সাধারণ সম্পাদক পদটি ঘিরে। এখন পর্যন্ত আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন দলটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শেষ হাসি তিনিই হাসবেন এমন ধারণা অনেকের।

তবে দলীয় হাইকমান্ডের দিক থেকে গতকাল পর্যন্ত কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও আলোচনায় রয়েছেন দলের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং কার্যনির্বাহী সদস্য আজমত উল্লাহ খান।

একটি সূত্র জানায়, গতকাল সম্মেলনস্থলে একজন সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে দলের হাইকমান্ড থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন কিনা। এ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে নানা আলোচনা ডালপালা ছড়াচ্ছে।
সব আলোচনা ও কৌতূহলের সমাপ্তি ঘটবে আজ সম্মেলনের শেষ দিন কাউন্সিল অধিবেশনে। এ অধিবেশনে সারাদেশ থেকে আগত কাউন্সিলরদের চিন্তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দলটির পরবর্তী নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হবে।

দলের সাড়ে সাত হাজার কাউন্সিলরের সঙ্গে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মাঠে নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য বসবেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি নীতিনির্ধারণী বক্তব্য রাখবেন। পরে গঠনতন্ত্র অনুমোদন ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সাধারণ সম্পাদকসহ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বিষয় বিবেচনায় রেখে আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। এ কারণে আমলনামার ভিত্তিতে বর্তমান নেতৃত্বের বেশ কয়েকজনের পদোন্নতি হবে। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন ১০ থেকে ১২ জন নেতা। ইতোমধ্যেই উপদেষ্টার সংখ্যা ৪১ থেকে ৫১ করা হয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, সভাপতিম-লী থেকে অনেককে উপদেষ্টাম-লীতে ঠাঁই দেওয়া হতে পারে। বিভিন্ন পদে আসতে পারে কয়েকটি নতুন মুখ। দুজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে সভাপতিম-লীর সদস্য করা হতে পারে। একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সম্পাদক পদে থাকা একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে পারেন। সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে বাদ পড়তে পারেন একজন, আরেকজনকে কেন্দ্রীয় সদস্য পদে নেওয়া হতে পারে।

এ ছাড়া সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্য পদে আসতে পারে বেশকিছু পরিবর্তন। শূন্য জায়গায় শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তান, বেশ ক’জন নারী ও সাবেক ছাত্রনেতা ও তৃণমূল নেতার ঠাঁই হতে পারে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, ছাত্রলীগের সাবেক কার্যকরী সভাপতি শাহে আলম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু, আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের ছেলে নাহিম রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন সংসদ সদস্য সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি,

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারী, মাহমুদ হাসান রিপন, ইসহাক আলী খান পান্না, বলরাম পোদ্দার, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিয়া খাতুন ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা শফী আহমেদ, সাবেক ছাত্রনেতা মনিরুজ্জামান মনির, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার,

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মেজর খালেদ মোশাররফের মেয়ে মাহজাবিন খালেদ, সাবেক সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি প্রমুখের নাম আলোচনায় রয়েছে।বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, বঙ্গবন্ধুর নাতি এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও নাতনি সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের প্রতি আওয়ামী লীগ ও সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকলেও এবারের কমিটিতে তাদের কেউ আসতে চান না বলে শোনা যাচ্ছে।

নেতাকর্মীর উচ্ছ্বাস আর করতালির মধ্যে শুক্রবার বেলা ৩টার পরপরই দলের ২১তম সম্মেলন উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে শেখ হাসিনা জাতীয় পতাকা ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর শেখ হাসিনা শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

এর আগে সকাল থেকে সম্মেলনস্থল ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে ভিড় করেন সারাদেশ থেকে আগত নেতারা। হাতে হাতে ব্যানার, পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন ফটকের সামনে জমায়েত হন। পোশাকেও ছিল বৈচিত্র্য। নারী নেতাদের মধ্যে অনেকে লাল-সবুজের পতাকার আদলে তৈরি শাড়ি পরে সেজেগুঁজে সম্মেলনে যোগ দেন।

আরা সাদা পাঞ্জাবির ওপরে মুজিব কোট পরে সম্মেলনস্থলে আসেন অনেক নেতা। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার সঙ্গে সাজুয্য রেখে তৈরি মঞ্চ ও প্যান্ডেলের নান্দনিকতার ছোঁয়াও ছিল চোখে পড়ার মতো। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল সম্মেলনের উদ্বোধনী সাংস্কৃতিক আয়োজন। দেশের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের উপস্থিতি ও তাদের প্রাণবন্ত পরিবেশনায় মুগ্ধ হন সমবেতরা।সূত্র: আমাদেরসময়

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *