Home » রবীন্দ্রনাথ সবার

রবীন্দ্রনাথ সবার

এম সি কলেজে বাংলা ও ইংরেজিতে পৃথক সেমিনারে বক্তারা , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লেখায় মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলেছেন। সকল মানুষ এক বিশ্ব মানবাত্মার অংশ। আমরা যে দেশেরই সন্তান হই না কেন-আমাদের জীবনের একই উদ্দেশ্য মানুষে মানুষে মিলন ও মৈত্রী স্থাপন। তাই বিভেদ-বৈষম্য পরিহার করে সকলকে এক মানবাত্মায় পরিণত হওয়ার আহবান জানান তারা।’ তারা এও বলেন, রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ এশিয়ার কোন বিশেষ সমাজের নয়, তিনি সবার।


ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজে কবির শুভাগমনের শতবর্ষ-পূর্তি উপলক্ষে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক দিনব্যাপী সেমিনারে বক্তারা এভাবেই তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। বিশ্বকবির সিলেট আগমনের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ স্মরণোৎসব’ এর অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার এমসি কলেজে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও উদ্বোধকের বক্তব্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, পৃথিবীকে জানার এবং জ্ঞান সাধনায় সাহিত্য একটি পথ। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথকে শুধু কবি বললে তাকে সীমিত করা হবে। তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী এক বিশাল মনের মানুষ ছিলেন। সব কিছুতেই তাঁর অবদান অকল্পনীয়-অসীম।


কলেজের শিক্ষাবিদ সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নিতাই চন্দ্র চন্দ। কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহনাজ বেগমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সেমিনার আয়োজক পর্ষদের আহবায়ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর শামীমা চৌধুরী। আয়োজকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন. শাবিপ্রবির বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জফির সেতু। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সিলেট-৫ আসনের এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদার, সাবেক সচিব এ এইচ মোফাজ্জল করিম, উৎসব আয়োজন পরিষদের যুগ্ম আয়বায়ক ব্যারিস্টার আরশ আলী, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকরামুল কবির প্রমুখ।


অনুষ্ঠানে বাংলায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন সভাপতি প্রফেসর বেগম আকতার কামাল এবং ইংরেজিতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর মোহিত উল আলম বাংলা সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর সৈয়দ আজিজুল হকের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর উষারঞ্জন ভট্টাচার্য, লিডিং ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের প্রধান ড. মোস্তাক আহমদ দীন, শাবিপ্রবির বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাসুদ পারভেজ, মদনমোহন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ, বিশিষ্ট গবেষক প্রফেসর নৃপেন্দ্রলাল দাশ, এমসি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাহেদা আখতার, সহযোগী অধ্যাপক মো. বিলাল উদ্দিন।

ইংরেজি অধিবেশনের সভাপতি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের প্রফেসর গোলাম সরওয়ার চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, শাবিপ্রবির ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিহির কান্তি চৌধুরী, ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. রানা ইসলাম, এমসি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রজত কান্তি সোম, লিডিং ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুম্পা শারমিন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সকাল ১০টায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে কলা ভবনের সামনে স্থাপিত বিশ্বকবির প্রতিকৃতি উন্মোচন করেন তিনি। অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি তার প্রথম এমসি কলেজ দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন এবং এর সৌন্দর্যে অভিভূত হয়েছিলেন বলে জানান।


উপস্থাপিত প্রবন্ধে বক্তারা বলেন, রবীন্দ্র চেতনায় বিশ্বজনীনতার প্রকাশ পেয়েছে। পুরো বিশ্বকে তিনি ‘হিউম্যান ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সেখানে ভারতবর্ষকে তিনি বিবেচনা করেছেন বিশ্ব মালায় গাঁথা একটি ফুল হিসেবে। তাই তিনি এক সংবর্ধনার জবাবে বলেছিলেন, ‘স্বদেশের ও রাষ্ট্রীয় অভাব মোচন করতেই জাতির আত্ম প্রকাশের সকল দায়িত্ব শেষ হয় না। দেশ কালের সীমানা অতিক্রম করে আপনাদের বাণী পৌঁছানো চাই সেখানে-যেখানে মনুষ্যত্বের নৈতিক সমস্যাগুলো আপনাদের বিচার ও বিবেচনার জন্য অপেক্ষা করছে।


বক্তারা জাতিতে জাতিতে আত্মীকরণ নয় আত্মীয়করণ করার কথা তুলে ধরে বলেন, মানুষ শুধু দেশের নয়, বিশ্ব মানবতার অংশ। বিশ্বকবি বিশ্বশান্তি ও গণমানুষের অনুকূলে নিজের বিবেককে দাঁড় করিয়েছিলেন।কবির লেখায় পূর্ব-পশ্চিমের মিলন ঘটানোর আকুতির কথা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, কবির বিশ্বজনীনতার মূলকথা প্রাণের সাথে প্রাণের মিলন। তিনি ব্যক্তি বা দেশ নয়, বিশ্ব জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।রবীন্দ্রনাথ মানুষের মুক্তির কথা বারবার উল্লেখ করেছেন জানিয়ে বক্তারা বলেন, তিনি বিশ্ব শান্তি মানে শুধু যুদ্ধ বন্ধ করা নয়, মানুষের শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। তাই তিনি মৈত্রী স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের মনুষ্যত্বের ভিত গড়ার কথা বলেছেন।

তিনি ইউরোপের ভোগবাদী সমাজ সম্পর্কে সেই সময় সতর্ক ছিলেন। ‘ইউরোপের বস্তু ও ভোগবাদী সমাজ আত্মাকে অস্বীকার করছে। ফলে মনুষ্যত্বের বিলোপ ঘটে হিং¯্রতার বিস্তার ঘটছে। তিনি আতিœক বাণীর চর্চা এই পূর্ব দেশ থেকেই শুরু হবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন।বক্তারা রবীন্দ্রনাথের ভাবনা, লেখা ও বক্তব্যে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি ও সা¤্রাজ্যবাদের ভয়ঙ্কর রুপ, গোরা চরিত্রের মাধ্যমে তার ধর্মীয় পরিচয় নয়, মানুষ হিসেবে তার পরিচয় তুলে ধরে বিশ্বমানব হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া, বাংলার নদী ও প্রাকৃতির সাথে কবির প্রেম, মরমী কবি হাসান রাজা সম্পর্কে কবির অভিব্যক্তি, গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষক-শ্রমিক-কর্মজীবী মানুষকে শ্রদ্ধা করা, সমাজতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মুরারিয়ানদের রবীন্দ্রবিশ্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জ্ঞানের মিলনের আহবান এবং মানবিক আদর্শকে যদি আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি ; তবেই এই উদযাপন সার্থক হবে বলে মন্তব্য করেন তারা। এমসি কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ‘আকাঙ্খা’ শিরোনামে কবির দেয়া বক্তব্যে তিনি সবজ্ঞানের মিলন, সর্বস্তরের মানুষের আকাঙ্খা এবং আকাঙ্খা পূরণে দুর্বার অধ্যবসায়ের কথা বলেছেন বলে জানান তারা। সে সময় সিলেট শহরে কবির অনুকরণে তরুণ যুবকদের বাবরি চুল রাখার প্রচলন দেখা গিয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। প্রথম পর্বের সমাপনী বক্তব্য রাখেন-কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ আহমদ।


ইংরেজি অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে প্রফেসর গোলাম সরওয়ার চৌধুরী বলেন, রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ এশিয়ার কোন বিশেষ সমাজের নয়, তিনি সবার । তিনি ভারতের জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতেরও রচয়িতা। এ থেকে তার সর্বেশ্বরবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও অনুপ্রাণিত ছিলেন।’ এ অধিবেশনে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শফিউল আলম। সূত্র: সিলেটেরডাক

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *