অনলাইন ডেস্ক: আফগানিস্তানে কট্টরপন্থি সশস্ত্র গ্রুপ তালেবানদের শিকড় যেমন পুরনো, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধু দেশগুলোর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সূচনার এত বছর পরও তাদের নতুন করে উত্থান যেন জানান দিচ্ছে কৌশলগতভাবে মার্কিন ব্যর্থতাকে। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভয়াবহ হামলার কুচক্রী আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া তালেবানকে পরবর্তী বছরগুলোতে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বহু চেষ্টাই চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
৯/১১-এর ওই ঘটনার এক মাস পর ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর তালেবান দমনে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা আফগানিস্তানে যে হামলা চালাতে শুরু করে তাতে সাময়িকভাবে হয়তো কট্টরপন্থি গ্রুপটি কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাঝে মাঝেই ছোটখাটো হামলা করে তালেবানরা ঠিকই জানান দিয়েছে, তারা একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়নি। উল্টো কৌশলগত নানা ভুলের কারণে অচিরেই আফগানিস্তানে অবস্থানরত লাখ লাখ মার্কিন সেনা এই যুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়া সময়ের পরিবর্তনে আফগানিস্তানে টানা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যয় নিয়েও নতুন করে ভাবতে হয় মার্কিন সরকারকে। যার পরিণতি ছিল আফগান সেনাদের হাতে কর্তৃত্ব বুঝিয়ে দিয়ে মার্কিন সেনাদের দেশে ফিরে যাওয়া। তার পরও আফগানিস্তানে অবস্থানরত লাখের বেশি মার্কিন সেনা তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও কট্টরপন্থিদের নবউত্থান রুখতে পারেনি। সম্প্রতি তো অনেকটা মাথা নুইয়েই আফগানিস্তানে ১৭ বছর ধরে চলা কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সমাপ্তে তালেবানদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু উল্টো গত সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে কাবুলে ভয়াবহ গাড়িবোমা হামলাসহ বেশ কয়েকটি ছোটখাটো ঘটনা ঘটিয়ে তালেবানরা
মার্কিনিদের বুঝিয়ে দেয়, শান্তিচুক্তিতে রাজি হলেও তারা আধিপত্যের মাঠ ফাঁকা হতে দিতে রাজি নয়। কাবুলে ওই হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তিচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেন। তবে তারও জবাব দিতে ভোলেনি তালেবানরা। ৯/১১-এর ১৮তম বার্ষিকীতে গতকাল বুধবার কাবুলের মার্কিন দূতাবাসের কাছে রকেট হামলা চালিয়ে তারা বুঝিয়ে দেয়, নতুনভাবে উত্থান ঘটছে তাদের। এমনকি তালেবান নেতারা হুমকিও দিয়েছেন, ট্রাম্পের শান্তি আলোচনা বাতিলের সিদ্ধান্তে আরও বেশি মার্কিন সেনা মরবে।
ওয়াশিংটন নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান পুনর্বাসনবিষয়ক স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেলের কার্যালয় (এসআইজিএআর) বলছে, দেশটিতে এত বছর ধরে চলমান যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পরও বর্তমানে আফগানিস্তানের ৫৯ জেলা তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। আংশিক নিয়ন্ত্রণে আছে অন্তত ১১৯ জেলা। বিবিসি এক জরিপে বলেছে, বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তত ৭০ শতাংশ জেলা নিয়ন্ত্রণ করছে তালেবান।
এমনকি কিছু কিছু জেলায় প্রতিষ্ঠিত আছে তালেবানদের ছায়া সরকারও। লন্ডনভিত্তিক থিংকট্যাংক ওডিআই (ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট) বলছে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সেনাদের চাপের মুখেও আফগানিস্তানজুড়ে এক ধরনের ছায়া সরকার ধরে রাখতে পারা তালেবানের বিরল কৃতিত্ব। তবে লক্ষণীয় হলোÑ তারা শুধু অস্ত্র দিয়ে শাসন করছে না, ন্যাটোর নিয়মিত বোমাবর্ষণের মধ্যেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও বিচারব্যবস্থা চালু রেখেছে। প্রতিটি প্রদেশে তাদের সামরিক কমান্ডারের পাশাপাশি পৃথক একজন ছায়া গভর্নরও আছে। স্থানীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সঙ্গেও যৌথ কাজের মাধ্যমে সম্পর্ক দাঁড় করিয়েছে।
চাপের মুখে টিকে থাকতে তালেবানদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যও কম নয়। বিবিসির তথ্যানুযায়ী, তালেবানদের বার্ষিক আয় এখন ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যার বেশিরভাগই আসে মাদকদ্রব্যের উৎস পপি ফুল চাষের মাধ্যমে। নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তালেবানরা বিস্তীর্ণ এলাকায় পপি ফুলের চাষ করে। অর্থের বিনিময়ে নিজ এলাকায় লোকজনকে ভ্রমণেরও সুযোগ দিয়ে আয় করে বিপুল অর্থ। এ ছাড়া তাদের আছে টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও খনিজ পদার্থের ব্যবসা। ফলে টিকে থাকতে নিজেদের অর্থনৈতিক দিকটিকেও মজবুত করেছে তারা।
কৌশলগত কী ভুল ছিল মার্কিনিদের
২০০১ সালে ৭ অক্টোবর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিল তারা হয়তো সহজেই আফগানিস্তানে তালেবানদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু বাস্তব যে অনেক বেশি কঠিন তারা বুঝতে পারেনি। যার জেরে দেশটিতে এখনো মার্কিন বাহিনীকে তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। গত ১৮ বছর ধরে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অবস্থানের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বেশ কিছু কৌশলগত ভুল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মিত্র দেশগুলোর এই যুদ্ধ নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, আফগানিস্তানে সরকার পরিচালনায় সুষ্ঠুতার অভাব ও তাদের নিজস্ব বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, পাকিস্তানের অসহযোগিতা,
ইরান রাশিয়ার গোপন মিশন এবং তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারা। বিবিসি তাদের বিশ্লেষণে বলেছে, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে টানা আট বছর আফগানিস্তানে তালেবান অনেকটাই ব্যাকফুটে ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তান থেকে এক লাখ সৈন্য সরিয়ে নেন। এটি আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে শক্তি পুনরুদ্ধারের সুযোগ করে দেয়। যখন আন্তর্জাতিক বাহিনী লড়াই থেকে সরে গেল, আর আফগান বাহিনী দায়িত্ব পেল, তখন তালেবানের জন্য কাজ আরও সহজ হয়ে যায়।
প্রতিনিধি