৩৮টি সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয় প্রশাসনিক ভবনে। সেখান থেকে পুরো কলেজের নান্দনিকতা একসঙ্গে উপভোগ করা যায়। দেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ কলেজের চিত্র এটি। এমসি কলেজ নামেই বেশি পরিচিত। কলেজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেশ মনোরম। হরেক রকম গাছ আর শত বছরের পুরোনো দালান দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ক্যাম্পাসে রয়েছে আঁকাবাঁকা রাস্তা আর ছোট ছোট টিলা। একাডেমিক ভবনের পাশে রয়েছে একটি বড় পুকুর। পুকুরের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ আর ঘাস।
অনেক শিক্ষার্থী পুকুরপাড়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটান। ক্লাসের ফাঁকে কেউ দলবদ্ধ হয়ে গ্রুপ স্টাডি করেন। কেউবা একতারা, তবলা, গিটার বাজিয়ে বন্ধুদের গান শোনান। কেউ শুধুই গল্পগুজবে ব্যস্ত থাকেন।এমসি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯২ সালে। সিলেটের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। আগে কলেজের অবস্থান ছিল সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজারের কাছে রাজা জিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী স্থানে। ১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে এফএ অর্থাৎ বর্তমানের উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস খোলার অনুমতি দিলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে এমসি কলেজ যাত্রা করে। কলেজটি ১৯১২ সালে সরকারি কলেজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান ক্লাস ও স্নাতক শ্রেণিতে পাঠদান শুরু হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কলেজের স্থান পরিবর্তন করে শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বর্তমান সিলেটের টিলাগড়ে ১২৪ একর জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। তখন কলেজের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ৫৬৮ জন। বর্তমানে আছে ১৪ হাজারের ওপরে। এখানে ১৫টি বিষয়ে স্নাতক ও ১৬টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। এমসি কলেজের পূর্বে রয়েছে সিলেট সরকারি কলেজ এবং উত্তরে রয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কলেজের সুবিশাল ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি বিশাল খেলার মাঠ। আরও আছে ক্যান্টিন, শহীদ মিনার, ২৫ হাজারের অধিক বই নিয়ে গ্রন্থাগার, স্পোর্টস রুম, অডিটরিয়াম, মসজিদ, বিপন্ন উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্নার, ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হোস্টেল ও বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন। প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য কলেজে মাত্র দুটি বাস রয়েছে। এজন্য অনেক সময় শিক্ষার্থীদের কষ্টও পোহাতে হয়। তবে শীঘ্রই আরও একটি বাস যুক্ত হবে বলে জানা গেছে।
শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমে পড়ালেখার মধ্যেই থেমে নেই। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও তারা জড়িত। এমসি কলেজে রয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠন ‘এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি’, নাট্য সংগঠন থিয়েটার মুরারিচাঁদ, মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ফটোগ্রাফি সোসাইটি, রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, ধ্রুবক ক্লাব, বোটানিক্যাল ক্লাব, ইকোনমিকস ক্লাব ও কেমেস্ট্রি ক্লাব। বছরজুড়েই তাই নানা অনুষ্ঠান চলে ক্যাম্পাসজুড়ে। মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ, বসন্তবরণ ও বর্ষাবরণ আয়োজন করে।দীর্ঘদিন ধরে এমসি কলেজের সাংস্কৃতি সংগঠনগুলো নিয়ে কাজ করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শামীমা আখতার চৌধুরী। তিনি সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রসঙ্গে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক বাতায়নে সংগঠনগুলোর আবির্ভাব হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতোই।
থিয়েটার মুরারিচাঁদ, মোহনা, কবিতা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনরে প্রযোজিত নাটক, গান ও কবিতার মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতার বার্তা শিক্ষার্থীদের প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধিচর্চায় প্রাণিত করছে।’
এমসি কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করছেন। কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অমিত বিক্রম দেব বর্তমানে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসায়’।
কথা হয় থিয়েটার মুরারিচাঁদের সদস্য বাংলা বিভাগে স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র রেজাউল রাব্বির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা নাটক মঞ্চস্থ করে সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরি।’
১৯১৯ সালে সিলেটে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমসি কলেজের তৎকালীন ছাত্ররা কবিগুরুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, শাহ এএমএস কিবরিয়া, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল অবদুল মুহিত, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামসহ অসংখ্য গুণীজন এমসি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌফিক এজদানী চৌধুরী বলেন, ‘কলেজ প্রাঙ্গণে অতিসত্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য আমরা উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। কলেজে শিক্ষার গুণগত মান কিভাবে বজায় রাখা যায় সেই লক্ষে আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করে যাচ্ছি।’
অধ্যক্ষের কথা
মেধা বিকাশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ’ আমাদের এই কলেজ। আমরা প্রথম বারের মতো ১২৭ বছর উদযাপন করতে যাচ্ছি। পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পাঠক্রম বহির্ভূত সৃজনশীল কার্যক্রমেও উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা যাতে অধিক সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে পারে, সেজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। তারা যেন অধ্যয়নরত অবস্থায় চাকরির বাজার সম্পর্কে ধারণা পায়, এজন্য নানা সেমিনারের আয়োজন করি। কলেজ লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বই আছে। এজন্য তাদের বাজারমুখী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ কর্নার নির্মাণ করেছি, যাতে শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে। প্রত্যাশা একটাই, আমার সব শিক্ষার্থী যেন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।’
প্রতিনিধি