ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় ‘সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে’ আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন এজাহারভুক্ত দুই আসামি নূরউদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম। রবিবার ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তারা এই জবানবন্দি দেন। এদিকে নুসরাত হত্যাকা-ে জড়িত অভিযোগে পুলিশ তার সহপাঠী পপি ওরফে শম্পা এবং কামরুন্নাহার মনিকে গ্রেপ্তার করেছে। নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার সময় পপি রাফির পা চেপে ধরেছিল। আগুনে রাফিকে পুড়িয়ে মারার সময় খুনিরা পপিকে শম্পা নামে ডেকেছিল। আর মনিও হত্যাকা-ে সরাসরি যুক্ত ছিল। এতে পাঁচজন অংশ নিয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।
ওদিকে নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার এজাহারনামীয় আসামি সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মকছুদ আলমকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সরাফ উদ্দিন আহম্মেদ গতকাল এ আদেশ দেন।
ফেনী পুলিশের কোর্ট ইন্সপেক্টর গোলাম জিলানী জানান, সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রীর গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার ৪ নম্বর আসামি পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মকছুদ আলমকে আদালতে তুলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পদির্শক (ওসি) মো. শাহ আলম ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলার বাদী অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু জানান, রবিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া নূরউদ্দিন ও শামীমের বক্তব্যে কাউন্সিলর মকছুদ আলমের নাম রয়েছে। তিনি এ ঘটনায় অর্থ জোগানদাতা।
আলোচিত এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও পিবিআই। এদের মধ্যে ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। এদের মধ্যে গত ৯ এপ্রিল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সরাফ উদ্দিন আহম্মেদের আদালত নূরউদ্দিন, কেফায়াত উল্যাহ, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও শাহিদুল ইসলামের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরদিন ১০ এপ্রিল অধ্যক্ষ এসএম সিরাজউদ্দৌলাকে সাত দিন, আবছার উদ্দিন ও আরিফুল ইসলামকে পাঁচ দিন করে রিমান্ড দেন একই আদালতের বিচারক। ১১ এপ্রিল উম্মে সুলতানা পপি ও যোবায়ের হোসেনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ড দেন একই আদালতের বিচারক সরাফ উদ্দিন আহম্মেদ। ১৩ এপ্রিল শনিবার মামলার আরেক আসামি জাবেদ হোসেনকে সাত দিনের রিমান্ড দিয়েছেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন।
এদিকে রবিবার রাতে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে নুসরাত হত্যাকা-ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আসামি নূরউদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম বলেছেন, অধ্যক্ষ সিরাজউদদ্দৌলার নির্দেশে তারা নুসরাতের গায়ে আগুন দেন।
মকছুদের দম্ভোক্তি
মাকছুদ আলমকে আদালত থেকে বের করার সময় অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেন, আমাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দিয়েছে, ছবি তোলেন। আসেন ছবি তোলেন। এ সময় সাংবাদিকরা ছবি তুললে তিনি আরও বলেন, ছবি আর লাইগব? লাগলে আরও তোলেন। এমন দম্ভোক্তিতে উপস্থিত সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। নুরুল আলম নামে এক মামলার সাক্ষী জানান, তিনি আওয়ামী লীগ করেন, কিচ্ছু হবে না। দুই দিন পর বের হয়ে যাবে।
কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৫ জন
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসাকেন্দ্রে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় অংশ নেয় পাঁচ জন। এদের মধ্যে চার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজনকে গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে পিবিআই।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পদির্শক (ওসি) মো. শাহ আলম বলেন, রাফি কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয় ৫ জন, অন্যরা তাদের সহযোগিতা করে। এদের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি একজনকে গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
নুসরাতের পা চেপে ধরে ছিল পপি
নুসরাত জাহান রাফিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করার সময় তার সহপাঠী পপি ওরফে শম্পা রাফির পা চেপে ধরেছিল। এ সময় হত্যাকা-ে অংশ নেয় তার আরেক সহপাঠী বান্ধবী। তবে হত্যাকা-ে অংশ নেওয়া নুসরাতের ওই সহপাঠী ও অধ্যক্ষ সিরাজের আত্মীয়; বর্তমানে পলাতক। পুলিশের তরফ থেকে তার নাম জানা যায়নি।নুসরাতকে আগুন দেওয়ার পর পপি ও ওই বান্ধবী দুজনই আগুন দিয়ে নেমে এসে হলে পরীক্ষা দিয়েছে। নুসরাত হত্যাকাণ্ডে আটক আসামিদের জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে আসে। আগুন দেওয়ার ঘটনায় অংশ নেওয়া শামীম ছাড়াও বাকি আটক দুই যুবক যুবায়ের ও জাবের। তারাও রাফিকে আগুন দেওয়ার সময় ঘটনাস্থলেই ছিল। এরা সবাই অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদের সদস্য।
ফেনী পিবিআইর অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান বলেছেন, নুসরাত মৃত্যুর আগে দেওয়ার জবানবন্দিতে (ডাইং ডিক্লারেশন) শম্পার নাম বলেছিলেন। যে চারজন বোরকা পরা নারী বা পুরুষ তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, শম্পা তাদের একজন বলে জানান নুসরাত।
ঘটনার পর পরই এজাহারভুক্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া সন্দেহভাজন যে ছয়জনকে আটক করা হয়, তার মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি ছিল। তবে পপিই যে শম্পা তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল।
অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান বলেন, ‘উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে আগেই গ্রেপ্তার হয়েছে। সে রিমান্ডের আদেশপ্রাপ্ত। তাকে এখনো রিমান্ডে আনা হয়নি।’
নূরউদ্দিন ও শামীমের জবানবন্দি
নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় ‘সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে’ আদালতে জবানবন্দি দেয় আসামি নূরউদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম। পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহেরুল হক চৌহান জানান, দুই আসামি রবিবার মধ্যরাতে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের খাস কামরায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
নূর ও শামীমকে আদালতে হাজির করা হয় রবিবার বেলা ৩টায়। এর পর তাদের জবানবন্দি গ্রহণ শুরু করেন বিচারক, তা চলে রাত ১টা পর্যন্ত।
দুই আসামি হত্যাকা-ের পুরো বর্ণনা দেন। তারা বলেছেন, কারাগারে থাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এ সময় তাদের সঙ্গে কারা ছিল, কীভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, বিষয়গুলো জবানবন্দিতে এসেছে।
মানববন্ধন
নুসরাত হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ফেনীতে বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন করেছে। গতকাল সোমবার বিকালে ফেনীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ফেনী জেলা শাখা। সুজনের ফেনী জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট লক্ষ্মণচন্দ্র বনিকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রহমান বিকম, ফেনী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর বিমল কান্তি পাল, ফেনী পৌরসভার মেয়র হাজী আলাউদ্দিন, ফেনী শহর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পারভেজুল ইসলাম হাজারী, ফেনী চেম্বারের পরিচালক গোলাম ফারুক বাচ্চু, শিক্ষক নেতা মহিউদ্দিন খোন্দকার, কবি ইকবাল চৌধুরী, ফিরোজ আলম, অধ্যক্ষ এম. মামুনুর রশিদ, বেসরকারি হাসপাতাল মালিক সমিতির সভাপতি হারুনুর রশিদ প্রমুখ। এসব মানববন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
সকালে শহরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কে হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেন। এ ছাড়া দুপুরে ফেনী জেলা জজ আদালত চত্বরে মানববন্ধন করে জেলা আইনজীবী সমিতি। এ সময় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী, সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্যাহ চৌধুরী স্বপন, বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। মানববন্ধনে আইনজীবীরা বিবাদী পক্ষে মামলা পরিচালনায় কেউ অংশ না নেওয়ার অনুরোধ জানান।
অধ্যক্ষ সিরাজের পরিবার লাপাত্তা
গত ১৪ এপ্রিল ঘরে তালা দিয়ে লাপাত্তা হয়েছে নুসরাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার পরিবার। বাড়িটির নাম ‘ফেরদৌস মঞ্জিল’। ফেনী পৌর এলাকার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী বাড়ি সড়ক। শহরের পাঠানবাড়ী রোড ধরে চৌধুরীবাড়ি হয়ে সড়কটি চলে গেছে মহিপাল পর্যন্ত। এখানকার মকছুদুর রহমান সড়কের একটি বাইলেনের একেবারে শেষপ্রান্তে সিরাজের বাড়ি।
এদিকে নুসরাত জাহান রাফির পরিবারের সদস্যদের উদ্যোগে নুসরাত জাহান রাফি স্মৃতি ফাউন্ডেশনের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। রবিবার বিকালে শেখ আবদুল হান্নানের সঞ্চালনায় ও শিক্ষানুরাগী কামরুল হোসেন টিপুর সভাপতিত্বে নুসরাত জাহান রাফি স্মৃতি ফাউন্ডেশন আত্মপ্রকাশ করে।
প্রতিনিধি