২০১২ সালের জুন থেকে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। ২০১৮ সালের জুনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, সে দেশের প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনো অ্যাসাঞ্জের রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুরক্ষার অবসান ঘটাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। উইকিলিকস একইরকমের অভিযোগ করে আসছে।
অ্যান্ডি নামের এক অ্যাসাঞ্জ-সমর্থকও ভাবছেন, দূতাবাসের বাইরে এলেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে। মার্কিন কূটনীতি ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য ফাঁসের দায়ে তাকে যাবৎজীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। ‘ইকুয়েডর তো হুমকি দিয়েই রেখেছে। তারা যে কোনও মুহূর্তে অ্যাসাঞ্জকে বের করে দিতেই পারে। সে কারণেই আমরা অনেকে মিলে আজ এখানে জড়ো হয়েছি। গতকালও আমরা অনেকে মিলে এখানে ছিলাম। এবং তাকে বের করে দেওয়ার আশঙ্কা থাকলে কালও আমরা এখানে থাকব।’
বৃহস্পতিবার উইকিলিকসের টুইটে বলা হয়, ‘ব্রেকিং: ইকুয়েডর সরকারের একটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র উইকিলিকসকে জানিয়েছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে বহিষ্কার করা হবে। অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আইএনএ পেপারস অফশোর স্ক্যান্ডাল। এরইমধ্যে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেফতারে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে’। পরে আরেকটি টুইটে বলা হয় দ্বিতীয় আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের সূত্র থেকে অ্যাসাঞ্জকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারে দ্বিতীয় দফায় নিশ্চয়তা পেয়েছে তারা।
টুইটার পোস্টে ইকুয়েডরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জো ভ্যালেন্সিয়া অবশ্য উইকিলিকস-এর দাবিকে ‘ভিত্তিহীন গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে ইকুডরের বর্তমান সরকারের প্রতি আস্থাশীল নয় অ্যাসাঞ্জ সমর্থকরা। তার বহিষ্কারের আশঙ্কায় শনিবারও দূতাবাসের সামনে ভীড় করতে থাকে সমর্থকরা। ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি চাই’, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা চাই’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে দূতাবাস প্রাঙ্গন।
অ্যান্ডি এএফপিকে বলেছেন, ‘তাকে কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না। তো আমরা কী করতে পারি আর? আমরা কেবল রাস্তা আটকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। এর মধ্যে দিয়ে অ্যাসাঞ্জকে জানিয়ে দিতে পারি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে তার ভূমিকার কথা আমরা ভুলিনি।’
দূতাবাসের বাইরে দায়িত্বরত ব্রিটিশ পুলিশের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে এএফপিকে বলেছেন, পরোয়ানা জারি থাকায় বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাসাঞ্জকে গ্রেফতার করা হবে। তবে সেখানে থাকা অ্যাসাঞ্জ সমর্থকদের কারণে কাজটি খুব সহজ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। দূতাবাস লাগোয়া দোকানগুলোতে যারা কর্মরত, তাদের কেউ কেউ এসে অ্যাসাঞ্জ সমর্থকদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’-এর শ্লোগান লেখা টি শার্ট পড়া এক ব্যক্তি বব মার্লে ও বিলি ব্র্যাগের দ্য ক্ল্যাশ গেয়ে অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গেছেন। সেখানকার ইয়োলো ভেস্ট বিক্ষোভকারীদের একটা ছোট দল দূতাবাস এলাকায় দাঁড়িয়ে ‘অ্যাসাঞ্জের মুক্তি চাই’ শ্লোগান তুলেছেন।
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সাড়া জাগানো বিকল্প সংবাদমাধ্যম উইকিলিকস বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয় ২০১০ সালে। মার্কিন কূটনৈতিক নথি ফাঁসের মধ্য দিয়ে উইকিলিকস উন্মোচন করে মার্কিন সাম্রাজ্যের নগ্নতাকে। সুইডেনে দুই নারীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠার পর ২০১২ সালের জুন থেকে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসের আশ্রয়ে আছেন উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তবে ধর্ষণের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন তিনি। বিশ্বজুড়ে ন্যয় ও সমতার পক্ষের অ্যাকটিভিস্টরাও মনে করেন, ওই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুক্রবার অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে দেখা করেছেন তার বন্ধু ভোগান স্মিথ। তিনি জানিয়েছেন, বহিস্কারের খবরে মানসিক চাপে পড়েছেন অ্যাসাঞ্জ। তিনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকতে চান।
ধর্ষণের অভিযোগে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আশঙ্কা, তিনি সুইডেনে গেলে সুইডিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে প্রত্যর্পণ করবে। আর যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বিচারের নামে মৃত্যুদণ্ড দেবে। তাকে দূতাবাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কার কথা জানানোর পর উইকিলিকস তাদের ইমেইল বিবৃতিতে বলেছে, “বিদেশে নিজের দুর্নীতির কেলেঙ্কারি ঢাকতে যদি প্রেসিডেন্ট মোরেনো একজন শরণার্থী প্রকাশকের সঙ্গে করা চুক্তি অবৈধভাবে বাতিল করে তবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না।”ইকুয়েডর দূতাবাস থেকে বের হলে সুইডেন বা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে প্রত্যর্পণ না করার নিশ্চয়তা চান অ্যাসাঞ্জ। গত বছর সুইডিশ প্রসিকিউটররা ওই অভিযোগের তদন্ত বন্ধ করে দেন। তবে জামিনের শর্ত ভঙ্গ করায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
ইকুয়েডরের বর্তমান সরকারের সন্দেহ, অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকস আইএনএ পেপারস ফাঁসে জড়িত। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মোরেনো ও তার পরিবারের একটি ব্যক্তিগত ছবি ফাঁসের সঙ্গেও অ্যাসাঞ্জের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করছে তারা। প্রেসিডেন্ট মোরেনো গত মঙ্গলবার স্থানীয় একটি রেডিওতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই দুই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে বলেন, “কারো ব্যক্তিগত একাউন্ট হ্যাক বা ফোনে আড়ি পাতার অধিকার অ্যাসাঞ্জের নেই। …আমরা অ্যাসাঞ্জ ও তার আইনজীবীদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলাম তিনি অনেকবার তা লঙ্ঘন করেছেন।” তবে অ্যাসাঞ্জকে বের করে দিতে তার সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা সে বিষয়ে মোরেনো কোনো মন্তব্য করেননি।
বার্তা বিভাগ প্রধান