সিলেটে মদন মোহন কলেজের প্রভাষক সাইফুর রহমানকে খুনের ঘটনায় এমসি কলেজের দুই শিক্ষার্থী স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তবে হোটেল থেকে লাশ দক্ষিণ সুরমায় নিয়ে যেতে যে অটোরিকশা ব্যবহার করা হয়, সেটির চালককে ঘিরে ওঠছে প্রশ্ন। পুলিশ বলছে, চালকের বিষয়টি তাদের তদন্তে আছে। তাকে খোঁজা হচ্ছে।গত রবিবার সকালে নগরীর দক্ষিণ সুরমার তেলিরাই এলাকা থেকে সাইফুর রহমানের (২৯) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি গোয়াইনঘাট উপজেলার ফলতইল সগাম গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে। এ ঘটনায় রবিবার দিবাগত রাতে আটক করা হয় এমসি কলেজের শিক্ষার্থী নিশাত তাসনিম রুপা ও মোজাম্মিল হোসেনকে। পরে সোমবার সকালে সাইফুরের মা রনিফা বেগম বাদী হয়ে দক্ষিণ সুরমা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় রুপা ও মোজাম্মিলকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সোমবার দুপুরে সিলেট মহানগর ৩য় হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তারা। জবানবন্দিতে সাইফুরকে হত্যার কারণ বর্ণণা করেন দুজনে।
রুপা সিলেট সদর উপজেলার শাহপরান (রহ.) থানাধীন ক্ষিদিরপুর দত্তগ্রামের (সুরমা গেইট) শফিকুর রহমানের মেয়ে, মুজাম্মিল সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার আলমপুরের নজির আলীর ছেলে। রুপা এমসি কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে অনার্স ২য় বর্ষের এবং মুজাম্মিল একই বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।রুপা ও মুজাম্মিলের জবানবন্দির বরাত দিয়ে দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল জানান, সাইফুর রহমান ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রুপাদের বাড়িতে লজিং থাকতেন। ওই সময়ে রুপার সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সম্পর্কে একপর্যায়ে বিরোধ দেখা দেয়। সাইফুর লজিং ছেড়ে মেসে ওঠেন। ২০১৭ সালে মুজাম্মিলের সাথে সম্পর্ক হয় রুপার। এতে ক্ষিপ্ত হন সাইফুর। তিনি রুপাকে অতীতের মতো ঘনিষ্ঠ মেলামেশার জন্য চাপ দেন। সাইফুরের কাছে রুপার সাথে কাটানো ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি, ভিডিও প্রভৃতি ছিল। এসব কারণে তাকে খুনের পরিকল্পনা করেন রুপা ও মুজাম্মিল।
জবানবন্দিতে তারা জানান, গত শনিবার সকালে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে যান রুপা। সেখানে সাইফুরকে ডেকে নেন তিনি। তাকে ঘুমের ওষুধমিশ্রিত সেমাই খাওয়ান রুপা। পরে দুজন মিলে নগরীর সোবহানীঘাটস্থ হোটেল মেহেরপুরে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ২০৬নং কক্ষে ওঠেন সাইফুর-রুপা। হোটেল কক্ষে যাওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়েন সাইফুর। তখন নিজের হাতব্যাগে রাখা রশি বের করে সাইফুরের গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেন রুপা। পরে পরিকল্পনা অনুসারে ফোন দেন মুজাম্মিলকে। মুজাম্মিল একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে হোটেলে আসেন। হোটেল থেকে সাইফুরকে বের করে নেয়ার সময় ব্যবস্থাপককে বলা হয়, সাইফুর অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন, তাকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। অটোরিকশায় তুলে সাইফুরের লাশ দক্ষিণ সুরমার তেলিরাই এলাকায় নিয়ে ফেলে দেয়া হয়।
এমন জবানবন্দির প্রেক্ষিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, যে অটোরিকশায় সাইফুরের লাশ দক্ষিণ সুরমায় নিয়ে যাওয়া হয়, সে অটোরিকশার চালক কোথায়? চালককে যদি সাইফুরের অসুস্থতার কথা বলে অটোরিকশা ভাড়া করা হয়ে থাকে, তবে তাকে হাসপাতালে না নিয়ে চালক দক্ষিণ সুরমায় যখন সবাইকে (রুপা, মুজাম্মিল ও সাইফুর) নামিয়ে দেন, তখন কি তার মনে অচেতন (প্রকৃতপক্ষে মৃত) সাইফুরের বিষয়ে প্রশ্ন জাগেনি যে হাসপাতালে না নিয়ে কেন তাকে দক্ষিণ সুরমায় নিয়ে আসা হলো?
সাইফুরকে হোটেল কক্ষেই হত্যার পর মরদেহ অটোরিকশায় তোলা হয়। এক্ষেত্রে অটোরিকশাচালক যদি সাইফুর মারা গেছেন, এটা নাও জানতেন, তারপরও সাইফুরকে অচেতন দেখে পাশেই থাকা ইবনে সিনা হাসপাতালে না নিয়ে কেন দক্ষিণ সুরমায় নিয়ে গেলেন? প্রশ্ন ওঠছে, তবে কি অটোকিশাচালকও হত্যার বিষয়টি জানতেন? তিনিও কি সহযোগী? নাকি বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে তিনি এ কাজ করেছেন?
এ বিষয়ে পুলিশ কি ভাবছে জানতে চাইলে দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল বলেন, ‘অটোরিকশাচালকের বিষয়টি আমাদের তদন্তের মধ্যে আছে। তিনি জড়িত কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাকে পাওয়া গেলে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা হবে।’তবে আদালতে রুপা ও মুজাম্মিলের জবানবন্দির বিষয়ে নতুন তথ্য পাওয়া গেল সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুসার কাছ থেকে।
এক প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আদালতে জবানবন্দিতে তারা বলেছে, সাইফুরের লাশ অটোরিকশায় তোলার পর তারা চালককে বলে, ‘এই লোকটা মনে হয় মারা গেছে। তুমি লাশ দক্ষিণ সুরমায় নিয়ে ফেলে আসো।’ তখন চালক রাজি হয়নি। পরে তাকে বড় অঙ্কের টাকা দেয়ায় সে লাশ নিয়ে দক্ষিণ সুরমায় ফেলে আসে। রুপা আর মুজাম্মিল অটোরিকশা থেকে আগেই পথে নেমে পড়েছিল।’’জেদান আল মুসা বলেন, ‘ওই অটোরিকশাচালককে আমরা খোঁজছি। তিনি লাশ গুমের অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।’
প্রতিনিধি