Home » পরকীয়া: একটি অসুস্থ মানসিকতা

পরকীয়া: একটি অসুস্থ মানসিকতা

ডেস্ক নিউজ:পরকীয় শব্দের অর্থ কী? আমাদের বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির অভিধানে এই জাতীয় তিনটি শব্দ দেয়া আছে- ‘পরকীয়’ ‘পরকীয়া’ ‘পরকীয়াবাদ’। এই তিনটি শব্দের অর্থ প্রায় কাছাকাছি।
প্রথমটির অর্থ পর সম্বন্ধীয়; অন্যের, দ্বিতীয়টি অর্থ প্রণয়িনী; পরস্ত্রী; কুমারী, তৃতীয়টির অর্থ বৈষ্ণবশাস্ত্রের বর্ণিত পরনারীর সঙ্গে প্রণয় সংক্রান্ত মতবাদ। উইকিপিডিয়াতে আছে- পরকীয়া (ইংরেজি: Adultery বা Extramarital affair বা Extramarital sex) হলো বিবাহিত কোনো ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকাণ্ড।

উইকিপিডিয়াতে যা লেখা আছে সমাজের মধ্যে এটাকেই পরকীয়া বলে। পরকীয়া একটি সামাজিক ব্যাধি। অসুস্থ মন মনন ও মানসিকতার পরিচায়ক। এই পরকীয়া শুধু একটি সংসারকে ধ্বংস নয়, একটি সমাজ জাতি ও রাষ্ট্রকে কলুষিত করে দিতে পারে। প্রতিনিয়ত এই পরকীয়ার কারণে বহু এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটছে যা সংসার ও সমাজকে অস্থির করে তুলছে। পরকীয়ার আক্রান্ত কোনো সংসার আজ পর্যন্ত টেকেনি, স্থায়ী হয়নি, সুখি হয়নি। সংসারে স্বামী বা স্ত্রী যেই হোক সংসার ভাঙ্গবেই।

মানুষের মন ও মানসিকতা যখন অসুস্থ হয়ে যায়, তখন পরনারী বা পরপুরুষের দিকে ঝুঁকে যায় বা ঝুঁকাকে অন্যায় বা অপরাধ বলে মনে করে না। এখানে স্বামী বা স্ত্রীর উভয়ের সতর্ক থাকতে হবে। একটি সুখি সমৃদ্ধ সংসারে যেকোনো মুহূর্তে নরকের সংসার হতে পারে যদি দুজনের একজন পরকীয়ায় জড়িয়ে পরে। যখন পরকীয়া জানাজানি হয়ে যাবে, তখন সংসার অনিবার্যভাবে ভেঙ্গে যাবে। অস্তিত্ব হারাবে একটি সুখি সমৃদ্ধ সংসারের। নিহত হতে পারে কেউ কারো হাতে। এমন খবরে তো আমাদের চারপাশে ভরপুর।

ইসলাম ধর্মে পরকীয়া:
এই পরকীয়ার ব্যাপারে সবচে কঠিন হলো আমাদের ইসলাম ধর্ম। ইসলাম ধর্মে পরকীয়াতো দূরের কথা পরকীয়ার ধারে কাছে যাওয়াকেই হারাম বা কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কোরআনের সূরা বানি ইসরাইলের ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে’ তোমরা যিনার নিকটবর্তী হয়ো না’। এখানে যিনার দ্বারা শুধু পরকীয়াই উদ্দেশ্য নয়। এখানে বিবাহ বহির্ভূত সবধরনের যৌন সম্পর্ককেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

এখন আমরা কোরআন হাদিসের আলোকে জানবো পরকীয়ার কী শাস্তি। কোরআন হাদিসে পরকীয়ার জন্য ভিন্ন আরেকটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম কোরআন থেকে পরকীয়ার শাস্তি জানবো-

سُورَةٌ أَنْزَلْنَاهَا وَفَرَضْنَاهَا وَأَنْزَلْنَا فِيهَا آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ () الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ () الزَّانِي لَا يَنْكِحُ إِلَّا زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً وَالزَّانِيَةُ لَا يَنْكِحُهَا إِلَّا زَانٍ أَوْ مُشْرِكٌ وَحُرِّمَ ذَلِكَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ

তরজমা : ‘এটি একটি সূরা, যা আমি নাযিল করেছি এবং যা (অর্থাৎ যার বিধানাবলি) আমি ফরজ করেছি এবং এতে আমি নাযিল করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাতে তোমরা উদেশ গ্রহণ কর। ব্যভিচারিনী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশত চাবুক মারবে। তোমরা যদি আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখ, তবে আল্লাহর দীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি কল্যাণবোধ যেন তোমাদেরকে প্রভাবিত না করে। আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। ব্যভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী বা মুশরিক নারীকেই বিবাহ করে। আর ব্যভিচারিণীকে বিবাহ করে কেবল সেই পুরষ যে নিজে ব্যভিচারকারি বা মুশরিক।’ (সূরা মুমিন : আয়াত নং ২-৩)।

এই আয়াত থেকে বিবাহিত নারী পুরুষের পরকীয়ার শাস্তি নির্ধারণ করেছেন ‘রজম’। রজম হলো পাথর নিক্ষেপ করতে করতে মেরে ফেলা। আর যদি বিবাহের আগেই যৌনকর্ম সাধন করে সেক্ষেত্রে তাদের শাস্তি হলো একশত চাবুক। এখন হাদিস থেকে পরকীয়ার ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর বাণী শুনবো-

قَالَ عَبْدُ اللَّهِ قَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَىُّ الذَّنْبِ أَكْبَرُ عِنْدَ اللَّهِ قَالَ « أَنْ تَدْعُوَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ ». قَالَ ثُمَّ أَىٌّ قَالَ « أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ مَخَافَةَ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ ». قَالَ ثُمَّ أَىٌّ قَالَ « أَنْ تُزَانِىَ حَلِيلَةَ جَارِكَ » فَأَنْزَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ تَصْدِيقَهَا (وَالَّذِينَ لاَ يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلاَ يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَلاَ يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا)

তরজমা : হজরত আব্দুল্লাহ বলেন, একলোক বললো- হে রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর কাছে সবচে’ বড়ো পাপ কোনটি? রাসূল উত্তর করলেন আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, অথচ আল্লাহই তাকে সৃষ্টি করেছে। অতপর লোকটি জিজ্ঞেস করলো এরপর কোনটি? যে ব্যক্তি তার নিজ সন্তানকে খাওয়ানো পরানোর ভয়ে হত্যা করে। অতপর লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো কোনটি? যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশির স্ত্রীর সঙ্গে যিনা করলো। অতপর আল্লাহর আয়াত নাযিল হলো বিষয়গুলো সত্যায়ন করে; ‘আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য মাবুদকে ডাকে, যারা ওই মানুষকে হত্যা করে যাকে আল্লাহ অনুমতি দেয়নি, আর যারা যিনা করে। যারা এইসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় অবশ্যই সে বিশালাকারের পাপ করো। (মুসলিম শরিফ : হাদিস নং ২৬৮)

হাদিস শরিফে যিনার শাস্তি-

عن أبي هريرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قضى فيمن زنى ولم يحصن أن ينفى عاما مع إقامة الحد عليه

তরজমা : হজরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবিবাহিত যিনারকারীর ব্যাপারে তিনি ফয়সালা করেচেন হদ জারি করেছেন একবছরের দেশান্তর দেননি (বুখারি : হাদিস নম্বর ৬৪৪৪)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে-

عن زيد بن خالد قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يأمر فيمن زنى ولم يحصن بجلد مائة وتغريب عام

তরজমা : হজরত যায়দ ইবনে খালিদ বলেন- আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি; তিনি আদেশ দিলেন অবিবাহিত যিনাকারীর ব্যাপারে একশত বেত্রাঘাত ও একবছরের দেশান্তর। (সুনানে কুবরা লিননাসায়ী : হাদিস নম্বর ৭২৩৪) উপরোক্ত হাদিস দুটি অবিবাহিত যিনার ব্যাপারে।

এখন হাদিস থেকে বিবাহিত ব্যক্তির যিনার ব্যাপারে জানবো যা আমাদের ভাষায় পরকীয়া-

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّهُ قَالَ أَتَى رَجُلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَهُوَ فِى الْمَسْجِدِ فَنَادَاهُ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّى زَنَيْتُ. فَأَعْرَضَ عَنْهُ فَتَنَحَّى تِلْقَاءَ وَجْهِهِ فَقَالَ لَهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّى زَنَيْتُ. فَأَعْرَضَ عَنْهُ حَتَّى ثَنَى ذَلِكَ عَلَيْهِ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ فَلَمَّا شَهِدَ عَلَى نَفْسِهِ أَرْبَعَ شَهَادَاتٍ دَعَاهُ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ « أَبِكَ جُنُونٌ ». قَالَ لاَ. قَالَ « فَهَلْ أَحْصَنْتَ ». قَالَ نَعَمْ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم « اذْهَبُوا بِهِ فَارْجُمُوهُ

তরজমা : হজরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, একজন মুসলমান লোক আসলো। রাসূলুল্লাহ মসজিদে অবস্থান করতে ছিলেন। লোকটি রাসূলকে ডাক দিলো- হে আল্লাহর রাসূল আমি যিনা করেছি। রাসূল তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। লোকটি মুখের দিকে গিয়ে বললো- হে আল্লাহর রাসূল আমি যিনা করেছি। রাসূল তার দিক থেকে এবারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এভাবে চারবার হলো। অতপর সে নিজের উপর চারবার সাক্ষ্য দিয়েছে। রাসূল বললো তুমি পাগলমী করছো? লোকটি বললো না। রাসূল জিজ্ঞেস করলো তুমি কী বিবাহিত? সে বললো- হ্যাঁ। অতপর রাসূল সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বললেন- তাকে নিয়ে যাও রজম করো। (মুসলিম শরিফ : হাদিস নম্বর ৪৫১৫)।

আজকে সমাজের চতুর্দিকে পরকীয়া আর ব্যভিচার। কারা করছে সবই আমাদের চোখের সামনে। এর একমাত্র কারণ হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললে বা ধর্মীয় শাস্তি বাস্তবায়ন করলে পরকীয়ার এমন সয়লাব হতো না। তাই আসেন ধর্মীয় অনুশাসনগুলো আমাদের জীবন বাস্তবায়ন করি, তাহলেই পরকীয়া এবং ব্যভিচার মুক্ত একটি সুস্থ সুন্দর জীবন ও সমাজ পাবো ইনশাল্লাহ!

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *