Home » সন্তান নিয়ে বাসায় ফিরলেন নারায়ণগঞ্জের সেই ইউএনও

সন্তান নিয়ে বাসায় ফিরলেন নারায়ণগঞ্জের সেই ইউএনও

হাসপাতাল ছেড়েছেন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা বীণা। ফুটফুটে কন্যাসন্তানকে কোলে নিয়েই ঘরে ফিরেছেন তিনি। মাঝে চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে হাসপাতালে কেটেছে তার এক মাস ১০ দিন।

একাদশ নির্বাচনের পর খোঁড়া অজুহাতে ওএসডি করায় মানসিক চাপ সইতে না পেরে অপরিপক্ব সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন বীণা। বিয়ের ৯ বছর পর প্রথমবারের মতো মা হলেও সন্তান ছিল বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে।

অবশেষে সুস্থ সন্তানকে নিয়ে শুক্রবার দুপুরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন বীণা। নিজের ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাস দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছেন তিনি। মেয়ের জন্য দোয়া কামনাও করেছেন।

মেয়ের নাম রেখেছেন ইয়োনা। ফেসবুক স্ট্যাটাসে বীণা লিখেন- ‘মহান আল্লাহর অপার রহমতে দীর্ঘ এক মাস ১০ দিন পর আমার ইয়োনা মামনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে। সবাই আমার মামনির দীর্ঘায়ু ও সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন।’

নির্বাচনে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলেও গত ৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার দায়িত্ব থেকে ওএসডি করা হয় বীণাকে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বীণা। পরে অপরিপক্ব সন্তানের জন্ম দেন। জন্মের পর থেকে তার সন্তানটি ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।

এর আগে ওএসডি করার পর ৯ ফেব্রুয়ারি বীণা একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন ফেসবুকে, যা তোলপাড় সৃষ্টি করে সব জায়গায়। স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল- ‘আমি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সাধারণত ফেসবুকে খুব একটা শেয়ার করি না। তবে আজ মনে হলো এখন চুপ করে থাকাটাও অন্যায়। তাই আজ আর না, আজ আমি বলব… আমি হোসনে আরা বেগম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ণগঞ্জ সদর, মাত্র ৯ মাস পূর্বে আমি এ পদে যোগদান করি।

আমার দীর্ঘ ৯ বছরের দাম্পত্য জীবনে বহু চেষ্টা চিকিৎসার পরও আমরা কোনো সন্তান লাভ করতে পারিনি। কিন্তু পাঁচ মাস আগে আমি জানতে পারি আমি দুই মাসের সন্তানসম্ভবা। এ ঘটনা আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার অপার রহমত ছাড়া আর কিছুই নয়, এ বিশ্বাস আমি প্রতিনিয়ত বুকে ধারণ করেছি। এ বিশ্বাস ও স্বপ্ন বুকে নিয়ে অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছিলাম।

উল্লেখ্য, আমি আমার বাবুকে পেটে নিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জ-৪ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের আংশিক নির্বাচন অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করি।

একজন নারী কর্মকর্তা হিসেবে অজুহাত, ফাঁকিবাজি এ বিষয়গুলোকে কখনই পুঁজি করিনি। যখন যে পদে কাজ করেছি, চেষ্টা করেছি শতভাগ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে। সন্তানসম্ভবা হয়েও এর কোনো ব্যতিক্রম আমি করিনি।

অথচ আমি সন্তানসম্ভবা হয়েছি শোনার পর থেকেই একজন বিশেষ কর্মকর্তা, যার নাম বলতেও আমার রুচি হচ্ছে না, বিভিন্ন মহলে আমাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে আমাকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলির পাঁয়তারা করেই চলেছিল।

আমার সন্তানসম্ভবা হওয়াটাকেই সে বিভিন্ন মহলে আমার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অথচ এই সন্তান পেটে নিয়েই আমি অত্যন্ত সফলভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এতে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অ্যাপ্রিসিয়েশনও পেয়েছি।

আমার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল এপ্রিলের ২০ তারিখ, তেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি ছিলাম। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিকালে রেগুলার চেকআপ করতে আমি হাসব্যান্ডসহ স্কয়ার হাসপাতালে আসি।

চেকআপ শেষে সন্ধ্যায় আমরা হাসপাতালে অপেক্ষা করছি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য, এমন সময় আমার একজন ব্যাচমেট ফোন করে জানায় আমার সদাসয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওএসডি করেছে অর্থাৎ আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করেছে।

আমার অপরাধ হলো আমি সন্তানসম্ভবা। আর তার চেয়েও বড় কারণ হলো- সেই তথাকথিত ক্ষমতাধর কর্মকর্তার ওপরের মহল কর্তৃক তদবির।

খবরটা শোনার পর আমি প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করতে পারিনি। আমি অ্যাজমার রোগী। প্রচণ্ড মানসিকচাপে আমার ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে আমার পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই আমার পেটের বাবু নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ডক্টর সেদিন রাতেই সিজার করে বাবু বের করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আমার পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে পর দিন সকালে আমার মাত্র ৩১ সপ্তাহ বয়সী প্রি-ম্যাচিউর বেবিকে সিজার করে বের করে ফেলা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিওতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

আমার এই নিষ্পাপ সন্তানটার কী অপরাধ ছিল? নাকি মা হতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল আমি জানি না!

তবে জানি একজন সব দেখেন তিনি আমার নিষ্পাপ মাসুম সন্তানের ওপর এই জুলুমের বিচার করবেন। এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোনো কর্তাব্যক্তিদের কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তাকে বলব তুমি এর বিচার করো!

আর যারা আমাকে একটুও ভালোবাসেন আমার নিষ্পাপ সন্তানটার জন্য দোয়া করবেন। ও সুস্থ হয়ে গেলে কোনো কষ্টের কথাই আমার মনে থাকবে না।’

ইউএনও হোসনে আরা বীণার স্ট্যাটাস নিয়ে দৈনিক যুগান্তর সংবাদ ছাপায়। পরে বিষয়টি উঠে সংসদেও। এমপিদের দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি তার ওএসডির আদেশ বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *