Home » আগুনে পুড়ে প্রাণ হারানোরা তিনটি পরিবারের সদস্য

আগুনে পুড়ে প্রাণ হারানোরা তিনটি পরিবারের সদস্য


চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : শনিবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। বস্তি ঘরগুলোর অবস্থান চাক্তাইয়ের কর্ণফুলী নদী এবং রাজাখালী খালের মোহনায়। কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য যে তালিকা প্রশাসন প্রস্তুত করেছে সেই তালিকায় এ বস্তিগুলোও ছিল। অনেকেই ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেও ৬০ থেকে ৭০ পরিবার সেখানে থেকে যায়। ভয়াবহ আগুনে পরিবারগুলোর ওপর নেমে আসে এক মানবিক বিপর্যয়।

চট্টগ্রাম মহানগরীর চাক্তাইয়ের রাজাখালী এলাকায় বস্তিতে লাগা ভয়াবহ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে ৯ প্রাণ। শনিবার শেষরাতে এ মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আগুনে পুড়ে প্রাণ হারানোরা তিনটি পরিবারের সদস্য। এই অগ্নিকান্ডে পুড়েছে প্রায় দুশ বসতঘর। যারা বেঁচে আছেন, সর্বস্ব হারিয়েছেন। তাদের মাথার ওপর এখন খোলা আকাশ।

ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মোঃ জসিম উদ্দিন জানান, খবর পেয়ে নন্দনকানন, চন্দনপুরা, লামার বাজার ও আগ্রাবাদ স্টেশনের ১০ গাড়ি অকুস্থলে ছুটে যায়। দমকল কর্মীরা প্রাণান্তকর চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। কাঠ, বাঁশ ও টিনের ছাউনিযুক্ত হওয়ায় এই শুকনো মৌসুমে ঘরগুলোতে খুব দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং কম সময়ের মধ্যে ভস্মীভূত হয়।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুনে দগ্ধ আটটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে তারা হলেন রহিমা আক্তার (৫৫), তার দুই মেয়ে নাজমা আক্তার (১৬), নাসরিন (৫), পুত্র জাকির (১০), আরেক পরিবারের হাসিনা আক্তার (৩৫), আয়েশা (৩৭) এবং সোহাগ (১৯)। নিহত অপর একজনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। তার বয়স ৭ থেকে ৮ বছর। সর্বশেষ অজ্ঞাতনামা এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, আগুন নেভানোর পর সেখান থেকে ৮টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের শরীর এতটাই দগ্ধ হয়েছে যে, চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। সেখানে বসবাসকারী পরিচিত ও স্বজনরা খোঁজখবর নিয়ে নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। তিনি জানান, তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাণহানির প্রতিজনের সৎকারের জন্য ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘর হারানো পরিবারগুলোর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী আরও সাহায্য প্রদান করা হবে। তবে যে জায়গায় বস্তি ঘরগুলো গড়ে উঠেছিল সেখানে পুনরায় ঘর বানিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠা এই জায়গা কোন ব্যক্তি মালিকানার নয়।

চট্টগ্রামের চাক্তাই রাজাখালীর ভেড়া মার্কেট এলাকায় ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত কিভাবে তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীরা সেখানে কাঁচাঘর বানিয়ে ভাড়া বাণিজ্য করে আসছিল। ভাড়া কম হওয়ায় স্বল্প আয়ের পরিবারের বসবাস সেখানে। ওই বস্তিতে বিদ্যুত সংযোগ থাকলেও গ্যাস ও পানির সংযোগ ছিল না।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক জানান, অগ্নিকা-ের কারণ উদঘাটনে ৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাশহুদুল কবিরকে আহবায়ক এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা আলী আকবরকে সদস্য সচিব করে গঠিত এ কমিটিকে ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

স্বজন ও ঘরহারানোদের আহাজারি ॥ প্রতিদিনের মতো শনিবারের রাতটিও গভীর ঘুমে কাটছিল সেখানে শ্রমজীবী পরিবারগুলোর। কিন্তু ভোরের আলো দেখার আগে তাদের দেখতে হলো ভয়াবহ আগুনের আলো। লেলিহান শিখা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে পুরো বস্তিতে শুকনো মৌসুমে কাঠ, বাঁশ ও টিনের ছাউনির ঘরগুলো পরিণত হয় সহজদাহ্য স্থাপনায়। আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে, কেউ মালামাল রক্ষা করতে পারেননি। সকলেই বেরিয়ে আসেন এক কাপড়ে।

বস্তির একটি ঘরে বসবাসকারী রহিমা আক্তার নিজের একটি সন্তানকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বের করে আনতে পারলেও বাকি তিন সন্তান আনতে গিয়ে আর ফেরেননি। তিন সন্তানসহ নিজেই পুড়ে অঙ্গার হলেন নাজমা। উদ্ধার পাওয়া কন্যা সন্তান নার্গিস (৯) জানায়, মা তাকে বের করে এনেছিলেন। তারপর আবার ঢোকেন ২ বোন ও এক ভাইকে আনতে। কিন্তু আর ফিরে আসেননি। সেখানে বসবাসকারী অন্যরা জানান, রহিমার বড় মেয়ে নাজমা ঘরে কাজকর্ম করতেন। আর জাকির ছিল স্থানীয় একটি স্কুলের ছাত্র।

আয়েশা আক্তার নামের যে নারী দগ্ধ হয়েছেন তিনি ছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা। আগুনের ভস্ম সরিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে আয়েশা ও তার বোনের ছেলে সোহাগের দেহ।

এদিকে কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে যে অভিযান চলছে সে ধারাবাহিকতায় এই স্থাপনাগুলোও গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা ছিল। সেখানে প্রায় দুশ পরিবারের বসবাস। উচ্ছেদ অভিযানের বার্তায় অনেকে এর মধ্যে অন্যত্র চলে গেছেন। তারপরও ৬০ থেকে ৭০টি পরিবার সেখানে বসবাস করছিল। বস্তির মালিকরাই তাদের আশ্বস্ত করে রেখে দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। উদ্দেশ্য বসবাসকারী স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোকে দেখিয়ে সহানাভূতি আদায়ের চেষ্টা।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ঘরগুলোর মালিক করা ছিল এবং এসব স্থাপনার বৈধতা খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *