দিদির চোখে-মুখে খেলে যাওয়া দ্যুতি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ধরনা উঠে যাচ্ছে।
মেট্রো চ্যানেলের ধরনামঞ্চে বসেই গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খবরটা পান। মুহূর্তেই উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন তিনি। মিনিট কয়েকের মাথায় উপস্থিত জনতাকে ‘খুশির’ খবরটি জানিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ‘নৈতিক জয়’ হয়েছে। এদিন সন্ধ্যায় তিনি যখন তিন দিন ধরে চলা ধরনার সমাপ্তি টানলেন, তখনো তাঁর মুখে জয়ের কথা।
এক অর্থে মমতার দাবি ঠিক। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার আপাতত গ্রেপ্তার হচ্ছেন না। সিবিআইয়ের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের এমন আদেশ বলতে গেলে তাঁর পক্ষেই গেছে। কারণ, মমতা অনমনীয়ভাবে যে কর্মসূচি (ধরনা) পালন করেছেন, তা তো সেই সিবিআইয়ের হাত থেকে রাজীবকে বাঁচাতেই।
রাজ্য সরকারের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘হার’ নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক। সামনে লোকসভা নির্বাচন। ফাইনাল টুর্নামেন্ট। এই সময় ‘হার’ হজম করলে আসল খেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই কিছুতেই হার স্বীকার করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও ‘আনন্দিত’। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের ভাষায়, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ সিবিআইয়ের জন্য ‘মহা নৈতিক জয়’।
কেন্দ্রের দাবিকেও নাকচ করার উপায় নেই। রাজীব কুমার এখন গ্রেপ্তার না হলেও তাঁকে সিবিআইয়ের জেরার মুখোমুখি হতেই হচ্ছে। সিবিআই তলব করলে নিরপেক্ষ ভেন্যু শিলংয়ে তাঁর জেরা হবে। কেন্দ্র তো এটাই চেয়েছিল!
ভোটের প্রাক্কালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে উভয় পক্ষ নিজেদের জয় হিসেবে দেখাতে চাইবেই। তা সত্ত্বেও খেলার এই পর্যায়ে জয়-পরাজয় যদি নির্ধারণ করতেই হয়, তবে বলতে হবে, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে টেক্কায় তৃণমূল কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এগিয়ে রয়েছেন।
মমতা আসলে একটা জুয়া খেলেছেন। চাঞ্চল্যকর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তাঁর দলের একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক ও নেতা আগে গ্রেপ্তার হলেও তখন মমতাকে কারও বাড়িতে দৌড়ে যেতে দেখা যায়নি। তখন ধরনায়ও বসেননি তিনি। কিন্তু গত রোববার রাজীবের বাড়িতে সিবিআই হানা দেওয়ামাত্র মমতা ছুটে যান পুলিশ কমিশনারের বাসায়। তাঁর পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে সেখানে বসেই তিনি ধরনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
পুলিশ বাহিনী ও তার মর্যাদার জন্য লড়ছেন বলে মমতার দাবি। সত্য-মিথ্যা তিনিই ভালো জানেন। তবে মমতার এই লড়াইয়ের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সুফলের দিকটি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।
পুলিশ কমিশনারের পাশে দাঁড়ানো, পুলিশের মর্যাদার জন্য ধরনায় বসা—মমতার এসব নাটকীয় তৎপরতায় পুলিশের আস্থা তাঁর ঝুলিতেই যাবে। ভবিষ্যতে এই আস্থার প্রতিদানও নিশ্চয়ই মিলবে।
গত কদিনের লঙ্কাকাণ্ডের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি নন, বরং মুখ্যমন্ত্রী মমতাই ভারতীয় রাজনীতির মুখ্য চরিত্র। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবার মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসেন মমতা। আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে খবরাখবর, নানামুখী আলোচনা চলে। ভোটের আগে নিজের পক্ষে ডামাডোল তৈরির কাজটা সফলভাবেই সেরেছেন মমতা।
মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সিবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ আছে। এবার সেই সিবিআই ইস্যুকে কেন্দ্র করেই মোদিকে কোণঠাসা করার কৌশল নিলেন মমতা। তাঁর ধরনা মোদিবিরোধীদের একটা বড় প্ল্যাটফর্মে পরিণতি হয়। সেই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ঝালাই ও ঐক্য দৃঢ় করার কাজটিও হয়ে গেল।
ধরনামঞ্চে মমতার সরব উপস্থিতিই বলে দিচ্ছিল, তাঁর কৌশল ক্লিক করেছে। ধর্মতলা থেকে মমতার ধরনা এবার যাবে দিল্লিতে।
প্রতিনিধি