সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় সংরক্ষিত বনের (ইকোপার্ক) বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ইজারা নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের বৈশাখী মেলা বন্ধ করা হয়েছে।
সংরক্ষিত বনের মধ্যে বৈশাখী মেলার আয়োজন ইজারা শর্ত ভঙের শামিল হওয়ায় মেলার প্রস্তুতি স্থগিত করে সিলেট বিভাগীয় বন বিভাগের কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) বন বিভাগ সরেজমিন গিয়ে মেলা ইজারাগ্রহিতাদের তলব করে মেলা গুটানোর বিষয়টি অবহিত করা হয়।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে সিলেট বিভাগীয় সহকারী বন সংরক্ষক মোহাম্মদ নাজমুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ‘লিজ গ্রহিতারা বুধবার আমাদের অফিসে আসেন। তারা জানান বনের ভেতর মেলা করা যায় না বিষয়টি তারা জানতেন না। না জেনে এমন আয়োজন করায় তারা দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বনের ভেতর থেকে সব সরঞ্জাম সরিয়ে নেন।’
সিলেটে বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় সিলেট বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি চিড়িয়াখানা হিসেবে ইজারা ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো। আগে ইজারাদার ছিলেন সিলেট মহানগর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুবেদুর রহমান মুন্না।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টিকিট আদায়ের কাজ দাপটের সঙ্গে করা হতো বলে এটি ‘যুবলীগের চিড়িয়াখানা’ হিসেবে পরিচিত ছিল।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেই দাপুটে ইজারাদারির ইতি ঘটে। ইজারাদার লাপাত্তা হওয়ায় প্রাণীর নিরাপত্তা হীনতায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি।
প্রায় ছয় মাস ইজারাবিহীন থাকার পর সম্প্রতি বন বিভাগের মাধ্যমে যুবলীগের চিড়িয়াখানার দায়িত্ব নিয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা। যুবলীগ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলে কর্তৃত্ব বদল হওয়ার বিষয়টি জানান দিতে সেখানে আয়োজন করা হয়েছে বৈশাখী মেলার।
‘এবার বৈশাখী মেলায় সিলেট ইকোপার্কে স্টল বরাদ্দ চলছে!’ ফেসবুকে এ রকম একটি পোস্ট দিয়ে স্টলদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এরপর ‘ফেসবুক লাইভ’ করার মধ্য দিয়ে চলে বৈশাখী মেলার স্টল বরাদ্দ। এ আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কথা বলা হলেও মূল উদ্যোক্তা লাহিন চৌধুরী। তিনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের কার্য-নির্বাহী কমিটির সদস্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইজারাদার পক্ষের ‘লাহিন চৌধুরী’ তার ফেসবুক আইডিতে বৈশাখী মেলার জন্য স্টল বরাদ্দ চলছে, এমন প্রচারণা চালান। লাহিন জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের জেলা কমিটির সদস্য। টিলাগড় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকেন্দ্র তিনিসহ স্বেচ্ছাসেবক দলের আরও কয়েকজন মিলে রক্ষণাবেক্ষণ ও টিকিট বেচাকেনার জন্য ইজারা নিয়েছেন।
‘জালাল এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত ২৮ মার্চ বন বিভাগের চুক্তিটি হয়। প্রতিষ্ঠানটি এক বছরের জন্য বন বিভাগকে ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ইজারা দিয়েছে। মেলার জন্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রবেশমুখে বাঁশ দিয়ে খুঁটি গেড়ে ১৩টি স্টল নির্মাণ করা হয়েছিল।
লাহিন জানান, দলীয় কোনো পরিচয়ে নয়, বৈধভাবে ইজারা নিয়েছেন। সেখানে তারা মেলার আয়োজন করছিলেন না। বাংলা নববর্ষের শুরু বৈশাখ মাসকেকে সামনে রেখে দর্শনার্থীদের খাবার ও পানীয় সরবরাহে প্রবেশমুখে কয়েকটি দোকান দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ কাজে তিনি তারা প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচও করেছেন। বিভাগ আপত্তি জানানোয় সেই সব স্থাপনা গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ৬২টি প্রাণী নিয়ে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর সংরক্ষণ কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। শুরু থেকে কেন্দ্রটি ব্যবস্থাপনার জন্য ইজারা নিয়ে পরিচালনা করছিলেন যুবলীগ নেতা সুবেদুর রহমান মুন্না।
তখন রাজনৈতিক দাপট খাটিয়ে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাফেটেরিয়া ইজারা নিয়েছিলেন। ইজারা নিয়ে শুধু নিজেদের ব্যবসার দিকটিই নজর রেখেছিলেন।
তার লোকজন সংরক্ষণ কেন্দ্রে রক্ষিত প্রাণীদের তদারকির গুরুত্ব দেয়নি। কেন্দ্রের দুটি জেব্রা, পাঁচটি ময়ূর, ১১টি কই কার্প মাছ, চারটি খরগোশ মারা গেছে। টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য দাবি, দর্শনার্থীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগও ছিল ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
গত ৫ আগস্ট সরকারের পট পরিবর্তনের পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান। এর পর থেকে ৪৫ দশমিক ৩৪ হেক্টর জায়গা ও বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছিলেন বন বিভাগের কর্মীরা।
রাজনৈতিক দাপটে ইজারাদারির কারণে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের অবস্থা এমন হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন পরিবেশ ও প্রাণী অধিকারভিত্তিক সংগঠন ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়ক মোহাম্মদ আশরাফুল কবির।
তিনি রাজনৈতিক ইজারাদার না দিতে বন বিভাগের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন। তার পরামর্শ ছিল, প্রাণীদের প্রতি মায়াহীন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া অনুচিত। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দাপটে ইজারাপ্রথা পরিহার করা উচিত।
কিন্তু পটপরিবর্তনের পর যুবলীগ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলকে ইজারা দেওয়াার মাধ্যমে সেই একই পন্থা অনুসরণ করল বন বিভাগ। সুত্র’- খবরের কাগজ