Home » ফল যা-ই হোক না কেন, শান্তিটুকু যেন নষ্ট না হয়!

ফল যা-ই হোক না কেন, শান্তিটুকু যেন নষ্ট না হয়!

ঘটনাচক্রে রুবাইয়ার ভোটকেন্দ্র মূল রাস্তার উপরে। সেখানে দাঁড়িয়েই মেয়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে পাশে দাঁড়ানো বাবা মহম্মদ শাহজাহান বলে উঠলেন, ‘‘আমি তো ওকে বলেছি, এ বারের ভোট সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ

‘‘ধর্ম নিয়ে কেন এমন চলছে, বুঝতে পারছি না। তবে যা চলছে, সেটা যে ভুল, তা বুঝতে পারছি।’’ চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বললেন অষ্টাদশী রুবাইয়া খাতুন। রবিবারই রুবাইয়া জীবনের প্রথম ভোট দিলেন।

মেটিয়াবুরুজের আক্রা রোডে তখন হাতে গোনা লোক। বোঝার উপায় নেই যে লোকসভা নির্বাচন চলছে। রাস্তার মুখে পুলিশ দাঁড়ানো। রয়েছে ‘নাকা চেকিং’-এর বোর্ড। প্রতিটা বুথের সামনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের কর্ডন। মৌলানা মহম্মদ আলি জোহর গার্লস হাই স্কুলের সামনে সেই বলয়ে দাঁড়িয়েই কথাগুলো বললেন সেই মেয়ে।

এমনিতে অনেকেই বলেন, বারাণসীর গলির সঙ্গে গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এলাকার গলিগুলির একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। যা শুনে কেউ কেউ হয়তো নাক কোঁচকান ঠিকই। কিন্তু বারাণসীর মতো গার্ডেনরিচেও কোন গলির গর্ভে কোন তস্য গলি, তা বোঝা যে মুশকিল তা মেনে নেন তাঁরাও।

ঘটনাচক্রে রুবাইয়ার ভোটকেন্দ্র মূল রাস্তার উপরে। সেখানে দাঁড়িয়েই মেয়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে পাশে দাঁড়ানো বাবা মহম্মদ শাহজাহান বলে উঠলেন, ‘‘আমি তো ওকে বলেছি, এ বারের ভোট সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ!’’ রুবাইয়া বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, বাবা বলেছিল। সত্যিই বুঝতে পারছি না যে ধর্ম নিয়ে এত কথার কী আছে?’’ যেমনটা বুঝতে পারছেন না গার্ডেনরিচের আরও এক প্রথম ভোটার শাহনওয়াজ আলমও। শাহনওয়াজ বলছিলেন, ‘‘বিরক্ত লাগছে এ সব শুনতে। কাজ নিয়ে কোনও আলোচনা হচ্ছে না। সকলে শুধু ধর্ম নিয়েই পড়েছেন।’’

পর্ণশ্রীর বাসিন্দা হিতেশেরও এটাই প্রথম ভোট। বিসিএ-র তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হিতেশও তিতিবিরক্ত ধর্মের কচকচানিতে। বেহালা পর্ণশ্রী বিদ্যামন্দিরে ভোট দেওয়ার পরে হাতের আঙুলে জীবনে প্রথম কালির ছাপ পড়ার উত্তেজনা নিয়েই হিতেশ বললেন, ‘‘ধর্মের জন্য তো কেউ ভোট দিচ্ছেন না। দেশের জন্য সকলে ভোট দিচ্ছেন।

এ ভাবেই দেশের জন্য ভোট দিতে গিয়ে কোথায় যেন এক হয়ে যায় ধর্ম নিয়ে মেতে থাকা মানুষের প্রতি রুবাইয়া, হিতেশ বা শাহনওয়াজের মতো প্রথম ভোটারদের বিরক্তি। শুধু তাঁরাই তো নন, রুবাইয়ার পঞ্চাশোর্ধ্ব বাবা যেমন মেয়েকে বুঝিয়েছেন ‘এ বারের ভোট কেন গুরুত্বপূর্ণ’, তেমনই বেহালার সত্তরোর্ধ্ব ত্রৈলোক্যনাথ চৌধুরীও বিশ্বাস করেন, ‘‘এ সব ধর্মের কথা বলে বিশেষ সুবিধা হবে না! মানুষ এত  সহজে বিভ্রান্ত হন না।’’

এ দিন বুথে বুথে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের ‘প্রবল’ উপস্থিতি। ইনসাস রাইফেল ও  এলএমজি-র মতো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাঁদের টহলও চলছিল। প্রতিটি এলাকার বাসিন্দাদের কুইক রেসপন্স টিম আলাদা ভাবে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘ঠিক মতো ভোট দিতে পেরেছেন তো?’ সব মিলিয়ে রামেশ্বরপুর রোডের কেএমসিপি স্কুল, পাহাড়পুর রোডের জি আর মৌলানা আজাদ মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল, মেটিয়াবুরুজ হাই স্কুল থেকে বেহালার পর্ণশ্রী বিদ্যামন্দির,  পোস্তার ভোটকেন্দ্রগুলি, বড়বাজারের বিনানি ভবন, মাহেশ্বরী ভবন-সহ সারা শহরের এমনটাই চিত্র। কোনও কোনও জায়গায় সে চিত্র খানিকটা এ দিক ও দিক হলেও তা ব্যতিক্রম!

যেমন এ দিন গার্ডেনরিচকে মোট তিনটি জ়োনে ভাগ করা গিয়েছিল। মোট ১৯টি ‘প্রেমিসেস’, ৫৯টি বুথ। রামনগর লেনের গালিব স্কুলের ভোটকেন্দ্রে দাঁড়ানো কলকাতা পুলিশের এক কর্মী বলছিলেন,  ‘‘এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই, কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি সব সময়েই ভোটারদের মনে ভরসা জোগায়।’’ বড়বাজারের বাসিন্দা সুজয় রাহা বললেন, ‘‘চিন্তা ছিল। কিন্তু শান্তিতে ভোট দিয়েছি।’’

সেই জওয়ানেরাও এ দিন দারুণ ‘বন্ধু’ ভোটারদের। যেমন প্রিন্স দিলওয়ার জা লেনের গাঁধী হিন্দি প্রাইমারি স্কুলের ভোটকেন্দ্রে দাঁড়ানো ভোটারদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর অ্যাসিস্ট্যান্ট কম্যান্ডান্ট, ‘‘ইতনা কম আদমি কিঁউ? শামকো লোগ হোতা হ্যায়?’’ ইতিবাচক উত্তর পাওয়ায় হিন্দিতে তাঁর সরস মন্তব্য, ‘‘শহরের লোক তো! সবার দেরিতে ঘুম ভাঙে!’’

মেটিয়াবুরুজের ট্র্যাফিক গার্ডের কর্মী রামকৃষ্ণ নন্দীকে ডিউটিতে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন নুরুল আলম। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কী হল, ট্র্যাফিক ভাইয়ের আজকেও ছুটি নেই? ভোট দেওয়া হল না তো!’’ রামকৃষ্ণবাবুর উত্তর, ‘‘ভোট দিয়ে এসেছি। আমাদের আবার ছুটি কী!’’ 

রুবাইয়ার বাবা শাহজাহান বলছিলেন, মেয়েকে আরও পড়াতে চান। শাহজাহানের কথায়, ‘‘গ্রাম থেকে শহরে এসেছি শুধু মেয়েকে পড়াব বলে। শান্তিতে ভোট দিতে পারলাম। পরেও যদি সব এমন শান্তিতে থাকে, তবেই তো পড়াতে পারব। ভোটে যে-ই জিতুক না কেন, এই শান্তিটুকু যেন নষ্ট না হয়!’’

শহরের মানচিত্র এক বিন্দুতে এসে মিশেছে এ দিন। আলাদা আলাদা জায়গা থেকে ওঠা ভিন্ন আওয়াজ এক হয়েছে। ‘ফল যা-ই হোক না কেন, শান্তিটুকু যেন নষ্ট না হয়!’ 

এ ভাবেই এ দিন তৈরি হয়েছে সমস্বর, শান্তি-প্রত্যাশী এ শহরে!

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *