Home » হাবিবের জীবন সংগ্রামে সফলতা

হাবিবের জীবন সংগ্রামে সফলতা

এনামুল কবীর, হাকালুকি থেকে ফিরে :: দুইবছর আগের ধাক্কা সামলে উঠেছেন হাবিবুর রহমান (২৬)। ২০১৭ সালে যখন হাওরের খামারগুলোতে মড়ক শুরু হয়েছিল, তখন তার প্রায় ৬০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে মরেছিল ২শ’র বেশি হাঁস।

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলেন হাওরপারের এই যুবক। তারপর আবার নতুন করে শুরু জীবন সংগ্রাম। সেই ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। আবারো হাঁসেই দেখছেন স্বপ্ন। অভাবমুক্ত জীবন আর সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়েতোলার স্বপ্ন।

সিলেটের আর দশজন যুবকের মতো হাবিবেরও স্বপ্ন ছিলো বিদেশ যাওয়ার। গিয়েছিলেনও। পিতার জমি বিক্রির টাকায় মধ্যপ্রাচ্যে ভাগ্য ফেরানোর লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু তা আর হয়নি। ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে। নিয়োগকর্তার প্রতারণায় দীর্ঘশ্বাস সম্বল করে প্রচন্ড হতাশায় যখন দিন যাচ্ছিল, তখনই পরম নির্ভরতার পাশে দাঁড়ান তারই এক মামা। হাঁসের খামার করার প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তিনি। ঋণ হিসাবে পুঁজিও দিয়েছিলেন। ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। ১শ’ হাঁস দিয়ে শুরু। সে আজ পাঁচবছর আগের গল্প।

পরের বছরেই তার খামারে হাঁসের সংখ্যা হয় আড়াইশ’। আরও একজন কর্মচারী নিয়োগ করেন। নিজেও কঠোর শ্রম দিতে থাকেন। দিন ঘুরতে থাকে। গড়ে সারাবছর তার ১শ\’ হাঁস ডিম দিতো। কর্মচারীর বেতন আর খাবারদাবার শেষে প্রতি মাসে থাকতো ১৫/১৬ হাজার টাকা। এতেই চলছিল স্ত্রী দুই সন্তান আর মা-বাবা ভাইকে নিয়ে ৭ জনের সংসার।

হাকালুকির হাওরপারে বাড়ি। গোলাপগঞ্জের শরিফগঞ্জ ইউনিয়নের ফনাইরচক গ্রামে। নিজের বাড়িতেই খামার। বর্ষায় হাওরের তীর ঘেঁষে হাঁসের দেখাশোনা করেন ছোট নৌকায়। আর শীতে পালা করে বিভিন্ন বিল আর হাওরের ছোট ছোট নদীতে।

দুইবারের চেষ্টায় এসএসসি পাশ করলেও এইচএসসি আর পাশ করতে পারেন নি হাবিবুর রহমান। রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসারের দায়িত্বপালনের চেষ্টা করছিলেন। বিদেশ বিদেশ করে জীবনের অনেকগুরো বছর কাটিয়ে, ২০১৪ সালের শুরুর দিকে বিশাল স্বপ্ন নিয়ে উড়াল দিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের ওমান। সেখানে মাসখানেক পর বুঝতে পারেন নিয়োগকর্তা একজন প্রতারক। কাজ নেই। শুয়ে-বসে দিন কাটাতে হয়। মাঝে মাঝে উপবাস।

একসময় সেই ওমানী সরাসরি তাকে বলে দেয়, আমার কাজ নেই। চুরি করে অন্য কাজ পারলে করো, নইলে বিদেয় হও। চেনাজানাদের সাথে পরমর্শ করেন। দেশের যে ট্রাভেল মালিকের মাধ্যমে গিয়েছিলেন, যোগাযোগ হয় তার সাথেও। তিনিও ‘কাজ নেই যখন বাইরের কাজ করো’ জাতীয় উপদেশ দিলে হতশায় মুষড়ে পড়েন হাবিব। কিন্তু জেলের ঘানি টানতে হতে পারে, এই ভয়ে অবৈধভাবে কোন কাজে যোগদান করেন নি। প্রায় ৩ মাস পর দেশে ফিরে আসেন।

অনেক দেনদরবার করে ট্রাভেল মালিকের কাছ থেকে লাখ টাকার মতো উদ্ধার করতে পারলেও এখনও দুইলাখ টাকা ফেরত পাননি। পাবেন সে আশাও আর নেই।

২০১৭ সালে যখন একদিনে তার প্রায় ২শ’ হাঁস মারা গেলো তখন প্রচন্ড হতাশা চেপে বসেছিল হাবিবের মনে। মনে হচ্ছিল কিছুতেই আর হবেনা। জীবনটাই অভিশপ্ত ইত্যাদি ইত্যাদি! সেই অবস্থা থেকে আবার নতুন করে শুরুর প্রেরণা দিলেন পরিবারের লোকজন। জমানো ২০ হাজার টাকার সাথে স্ত্রীর দেওয়া আরও দশহাজার দিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম শুরু করলেন তিনি।

সম্প্রতি হাকালুকি হাওরে নিজের হাঁসের রাখালি করতে করতে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপ হয় হাবিবের। ম্লান হেসে নিজের ছবি তুলতে আপত্তি জানালেও জীবন সংগ্রামের ঝাঁপি মেলে দিলেন অবলীলায়।

প্রায় ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারেন নি। তবে মাত্র ৪০ হাজার টাকায় তিনি তা পেরেছেন। খামারটি দিন দিন আরো বড় হচ্ছে। বর্তমানে ২শ’ হাঁস থাকলেও খুব তাড়াতাড়ি তা ৩শ’ হয়ে যাবে। আরেকজন কর্মচারী নিয়োগের চিন্তা করছেন।

আপাতত হাওরেই আস্তানা গেড়েছেন। থাকার জন্য ছোট্ট ঘর (উরা) আছে, আছে রান্নাবান্নার ব্যবস্থাও। নেট দিয়ে তৈরি করেছেন হাঁস রাখার আরও দুটি ঘর। প্রতিদিন ডিম নিয়ে যান বাড়িতে। সেখান থেকে নিয়ে যায় পাইকার। আর নিজে বাজার-সওদা নিয়ে আসেন।

হাসতে হাসতে বললেন, ভালোই যাচ্ছে দিন। আপাতত সব স্বপ্ন আর জীবন সংগ্রামের পুঁজি এই হাঁস। পেটের ভাত থেকে ঔষধ, ভাই আর সন্তানদের লেখাপড়াও চলছে এই হাঁস থেকে।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *