Home » মুক্তিযোদ্ধের তাহিরপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মুক্তিযোদ্ধের তাহিরপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

২৫শে মার্চ কালো রাত্রির ভয়ংকর হত্যার পর- ২৬শে মার্চ ঢাকায় পাকসেনাবাহিনীর মানব ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞে ক্ষণিকের জন্য শঙ্কিত হলেও পর মুহুরর্তেই তাহিরপুর এলাকার জণগন প্রতিরোধ এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ করে এই সদস্যদের নিয়ে অল্পক্ষণিকের মধ্যেই একটি মুক্তিবাহিনী দল গঠন করে। স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব আব্দুর জহুর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

২৭ মার্চ তাহিরপুর বাজারে তঁার নেতৃত্বে এক বিরাট জনসমাবেশ ঘটে। উক্ত জনসভায় পাক বাহিনীকে প্রতিহত করার দৃঢ়বদ্ধতা ঘোষনা করে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিল শেষে গণ-সংগ্রামকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জনাব আব্দুর জহুরকে সভাপতি ও জনাব নুরুল হুদাকে(আখঞ্জী) সাধারণ সম্পাদক করে তাহিরপুর থানা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে নিরাপত্তা ও সঠিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো চিন্তা করে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প এলাকার সংগ্রামী নেতৃবিন্দদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে তাহিরপুর থানা সংগ্রাম কমিটির সদর দপ্তর সীমান্তবর্তী টেকেরঘাটে স্থানান্তর করা হয়।

পরবর্তিতে তাহিরপুরের সংগ্রামী জনগণ যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সংগ্রাম কমিটিকে তথা প্রতিরোধ তৎপরতাকে সফল করে তোলার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তারা হলেন সর্বজনাব-

*আঃ নুর (আখঞ্জি) * আঃ আজিজ *সুবেদার গণি *আলী আমজাদ *কালা মিয়া (তাহিরপুর) *রাজেন্দ্র পুরকায়স্থ (চিকসা) * আঃ কাদির (রতনশ্রী) *হাজী রহিম উদ্দিন * আঃ কুদ্দুছ * আঃ কাদির তালুকদার *মোঃ মইনুল হক * আঃ ছোবহান (বড়দল) *আঃ হান্নান *রমিজ উদ্দিন (কাউকান্দি) *ফটিক মেম্বার (গোলকপুর) *আশজদ আখঞ্জি * শহীদ তালুকদার (তরঙ্গ) ** আঃ হামিদ *দুলা মিয়া * আঃ মতিন (শ্রীপুর) *মকবুল হোসেন মাষ্টার (পাটাবুকা) *ইসমাইল মড়ল (লামাগঁাও) *মুক্তার আলী * আঃ রউফ (রামজীবনপুর) *ফতে আলী মজুমদার * আঃ ছালাম (বালিজুড়ী) *কাজী আঃ কাদির (শক্তিয়ারখলা) * আঃ সাত্তার (দুর্গাপুর) *লায়েছ চেয়ারম্যান (সিরাজপুর) *মোজাহিদ উদ্দিন (বাদাঘাট) *গোলাম মোস্তফা *আতাউর রহমান (মোল্লাপাড়া) *জালাল উদ্দিন (মুদাইরগঁাও) *আবু তাহের *কালু মেম্বার (কাশতাল) *আব্দুল মজিদ (শিবের চর) ইত্যাদি তাদের অবদান মূখ্য ভুমিকা রেখেছিলো সেইসময়।

২৮ এপ্রিল তাহিরপুর থানার ওসি শফিকুর রহমান, ইপিআর-এর সুবেদার আব্দুল হাই ও চুনাপাথর প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিয়ে তাহিরপুরে প্রাথমিক সশস্ত্র প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন।

দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কথা চিন্তা করে কয়েকদিন পরে সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের টেকেরঘাট শাখা ঘটিত হয়। এ কমিটিতে ছিলেন জনাব আব্দুজ জহুর এমপিএ *বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত *জনাব হোসেন বখত *জনাব আলী ইউনুছ এডভোকেট *কমরেড নজির হোসেন প্রমুখ।

টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থে সকল দল ও মতের লোক একত্রে মিলে কাজ করেন। এ সাব-সেক্টরে সকল বেসামরিক কাজকর্মের নেতৃত্বে থাকেন সর্ব জনাব আব্দুজ জহুর এমপিএ এবং সামরিক কাজকর্মের দায়িত্বে থাকেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপিএ। শেষোক্তজন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মধ্যে যোগসূত্র সাধনের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কিছুদিন সাব-সেক্টর কামান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে মেজর মুসলিম উদ্দিন সাব-সেক্টর কামান্ডারের দায়িত্ব গ্রহন করেন। সেক্টরের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন সর্বজনাব আলী ইউনুছ এডভোকেট, কমরেড নজির হোসেন, সালেহ চৌধুরী, ডাঃ নজরুল হক, ডাঃ হারিস উদ্দিন প্রমুখ। কিছু দিন পর-

১৫ই সেপ্টেম্বর পাক বাহিনী বিপুল ৈসন্য ও অস্ত্রাদি নিয়ে অতর্কিতে তাহিরপুর আক্রমন করে বসে। তাহিরপুরে তখন স্বল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছিল এবং তাদের কাছে পর্যাপ্ত যুদ্ধোপকরণ না থাকায় তারা আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধ সৃষ্টি করে টেকেরঘাটের দিকে সরে আসতে থাকে।

ওদিকে পাকবাহিনী দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় গোলাবর্ষন করতে করতে বড়দল কাউকন্দি হয়ে শ্রীপুর বাজার করায়ত্ব করে ডাম্পের বাজার পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে টেকেরঘাট সদর সাব-সেক্টরে আক্রমণ চালায়। জবাবে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ক্যাপ্টেন বার্মার নেতৃত্বে বিএসএফ তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার স্বার্থে পাকবাহিনীকে লক্ষ্য করে ৫ইঞ্চি মর্টার ও এমএমজি দিলে গোলাবর্ষণ করে এবং সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী তাদের সুরক্ষিত ব্যাংকার সমূহ থেকে পাল্টা আক্রমণ চালায়।

সারারাত উভয় দলের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় চলে। পাকবাহিনী বৃষ্টির মত গোলা বর্ষণের প্রচণ্ডতায় অগ্রসর হতে না পেরে ভোর রাতে তাহিরপুরে পপশ্চাদপসরণ করে সেখানে শক্ত ঘঁাটি গেড়ে বসে। টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের কামান্ডার মুসলিম তঁার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত রেখেছিলেন।

২ নভেম্বর পাক সেনাদের একটি সেকশন রসদপত্র নিয়ে সাচনা থেকে গোবিন্দপুর হয়ে তাহিরপুরে আসছিল। মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদ এবং মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার নেতৃত্বে আরো একটি প্লাটুন আনন্দনগর নামক স্থানে পাক সেনাদের অ্যাম্বুশে ফেলে। কিছু সংখ্যক পাকসেনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ২টি নৌকা, ২টি রাইফেল এবং প্রচুর পরিমাণে খাদ্য সামগ্রী মুক্তিবাহিনী হস্তগত হয়।

৩ নভেম্বর ক্যাপ্টেন মুসলিম এবিং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি তাহিরপুর পাক ঘঁ াটি আক্রমণ করে। এই ঘঁ াটিতে এক কোম্পানির অধিক পাক সেনা ছিল। এখানে সংঘর্ষ আধাঘণ্টা স্থায়ীত্ব ছিলো। সংঘর্ষে ৩৮ জন পাক সেনা নিহত হয় এবং আহত হয় অসংখ্য। শহিদ হলেন আবুল কাশেম নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু পাকিস্তানীদের ব্যাপক হামলার মুখে ক্যাপ্টেন মুসলিম ও তার বাহিনী নিয়ে পিছনে সরে আসতে বাধ্য হন। ১২ দিন ধরে তাহিরপুর অবরোধ করে রাখা হয়। তাহিরপুরের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। বন্ধ হয়ে যায় খাদ্য সরবরাহ।

এরূপ অবস্থায় ২৮ নভেম্বর ক্যাপ্টেন মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানি নিয়ে ভোর ৫টায় আবারো তাহিরপুর আক্রমণ করেন। অবশেষে সকাল ৬টার মধ্যে তাহিরপুর শত্রু মুক্ত হয়। পাক সেনারা চরম ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যায়। তাহিরপুর দখলের পর মুক্তিবাহিনী বাজিতপুর পর্যন্ত সমগ্র সুরমা নদী এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণে বিধ্বস্ত পাক সেনারা লেজ গোটানো শুরু করে।

টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের মুক্তুযোদ্ধাদের মধ্যেও শুরু হয় উৎসাহ উদ্দীপনা। ইতোমধ্যে তাহিরপুর ছেড়ে জামালগঞ্জে পিছুটান দিয়েছে পাকবাহিনী। টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের কামান্ডার মেজর মুসলিম উদ্দিন এবং ফিল্ডসহকারি লেফটেন্যান্ট কাজী বশির উদ্দিনসহ মুক্তিসেনা ও স্থানীয় নেতৃবিন্দ পায়ে হেঁটে জামালগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

এদিকে তাহিরপুর থেকে চলে পাক সেনা জামালগঞ্জে তাদের দোসরদেরসহ ৭ ডিসেম্বর অনবরত মেশিনগানের গুলি ছুড়তে ছুড়তে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে নদী পথে পিছু হাটতে বাধ্য হয়। ৫ নম্বর সেক্টরভুক্ত বালাট সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মেজর (অব:) এম এ মোতালিব মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন যাদব এবং ক্যাপ্টেন রঘুনাথ ভাটনগরের যৌথ নেতৃত্বে তিন হাজার মুক্তি ও মিত্রবাহিনী গভীরাতে সুনামগঞ্জ মুক্ত করার জন্যে আক্রমণ করে মুক্ত করেন।

শ্রদ্ধার সাথে স্বরন করছি দেশ স্বাধীনতার লক্ষে মহান মুক্তি সংগ্রামের তাহিরপুর অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম কমিটি নেতৃত্বদানকারি সভাপতি সম্পাদক এবং সেক্টর ও সাব সাব সেক্টর প্রধান মহোদয়দের কে, এবং বীর সদস্য

প্রয়াত সর্ব জনাব আব্দুজহুর এমপি এবং প্রয়াত আব্দুনুর আখঞ্জী ” উনাদের সাথে সহযোগী আরো অন্যন্য ব্যক্তিত্ব দের,তার সাথে শ্রদ্ধার সাথে স্বরন করছি বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা ইতিমধ্যে প্রয়াত তাদের যেন আল্লাহতালা জান্নাতবাসী করেন, এবং যারা জীবিত আছেন তাদের কে নেক হায়াত দান করেন,ডিসেম্বর প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর সাথে লড়াই করে পাকিস্তানী পাক দখলদার বাহিনীকে সুনামগঞ্জ এর তাহিরপুর এলাকা শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তলন করেনন।দেশ মাতৃকা রক্ষায় দৃঢ় প্রত্যয়ে এ অঞ্চলের দামাল ছেলেরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানী পাক হানাদার বাহিনীকে তাহিরপুর কে মুক্ত করেন। পাকসেনারা সুনামগঞ্জ থেকেও পালিয়ে যায়। অতপর, সুনামগঞ্জ ও মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। তৎক্ষনাৎ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত করা হয়।

*তথ্য = TS.S(souvenir) 2009.M.B Alom.

লেখক ম.শওকত আখঞ্জী

উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *