চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার পথে সড়কের মাঝপথেই চুরি হয়ে যাচ্ছে বিদেশে রপ্তানীর জন্য তৈরী পণ্য। বিশাল একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করে আসলেও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে মূলহোতারা। মাঝে মধ্যে গুটি কয়েব ধরা পড়লেও আসল অপরাধীরা ধরা পড়ছেনা। ফলে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে তৈরী পোষাক শিল্পখাত। তেমনি রফতানির চালান না পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বিদেশী ক্রেতারা।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ ধরে ঢাকাÑ চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় ঘটে চুরির ঘটনা। সড়কের মাঝপথে চলন্ত গাড়ি থেকে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, কিছু চালক ও সড়কে ডিউটিরত কিছু ক্ষতিপয় পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসব চুরির ঘটনা ঘটছে। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, মীরসরাই ছাড়াও কুমিল্লা এলাকায় মহাসড়কে সব সময় সক্রিয় এই পণ্য চোর চক্র। পণ্য পরিবহন করা কাভার্ডভ্যান তালা মেরে সিলগালা করা থাকে। পণ্যের কার্টনও থাকে বরাবর। শুধু থাকে না কার্টনের ভেতরে রাখা রপ্তানি পণ্য-সামগ্রী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাভার্ডভ্যানে পরিবহন করা রফতানি পণ্য অভিনব কৌশলে চুরি করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এ চক্রে রয়েছে কাভার্ডভ্যান চালক, চালকের সহকারী, ব্যবসায়ী, দোকানদার, ডিপো মালিক, নিরাপত্তাকর্মী, শ্রমিক, ক্রেতাসহ ৩৫ সদস্যের একটি চক্র। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় তারা ছড়িয়ে আছেন। তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ঘটে একেকটি চুরির ঘটনা।
সূত্র মতে, চক্রের সদস্য কাভার্ডভ্যান চালক, সহকারী চট্টগ্রামে অবস্থান করা অন্য সদস্যদের প্রথমে ফোন করে চালানের তথ্য দেন। পণ্যের পরিমাণও জেনে নেন তারা। তারপর সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। কাভার্ডভ্যান কুমল্লিা, মিরসরাই, সীতাকুন্ড বা চট্টগ্রাম শহরে ঢোকার পর সুযোগ বুঝে পুরো চুরির কাজ শেষ করা হয়। এসব জায়গায় তাদের নির্ধারিত ডিপোতে কাভার্ডভ্যান ঢুকিয়ে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যেই চুরির কাজ শেষ করে। কাভার্ডভ্যানের সিলগালা করা তালা না ভেঙে তারা দরজার নাট খুলে ফেলে। তারপর ভেতরে থাকা কার্টন থেকে অর্ধেক পণ্য সরিয়ে নিয়ে পুনরায় টেপ লাগিয়ে দেয়। কোনো কার্টন থেকেই সব পণ্য সরানো হয় না। তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্ধেক এভাবে পণ্য সরানো হয়। পরে আবার এসব পণ্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় বড় শপিংমলগুলোতে বিক্রি করা হয়। কিছু কিছু রপ্তানিও করে তারা।
গত ১৯ নভেম্বর এমন একটি চক্রের ৪ সদস্যকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। সাভারের একটি কারখানার ৪ হাজার ৫শ ৬৮ সেট কাপড় চুরির ঘটনায় তাদের আটক করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা দুইজন হলেন-শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার থিরোপাড়া এলাকার আবদুল মজিদের ছেলে মো. কাশেম (৪৩) ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হাজিপাড়া এলাকার মো. আবদুল লতিফের ছেলে মো. রাশেদ (৩৫)। আটকরা স্বীকার করেছে, এই চক্রে যুক্ত আছে অন্তত ৩০ জন সদস্য। যারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সক্রিয়।
এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর সদরঘাট থানার স্ট্রান্ড রোডের আদিলা অ্যাপারেলস থেকে জাপানে রফতানির জন্য ৫৪৫ কার্টন তৈরি পোশাক সীতাকুন্ড পোর্টলিংক ডিপোতে নিয়ে শিপিং এজেন্টকে হস্তান্তর করে। পরে প্রক্রিয়া শেষে সেগুলো বায়ার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পণ্যগুলো চেক করার সময় একটি চালানে ২ হাজার ৭৩৪ পিস জ্যাকেট কম পায় এবং একটি কার্টনের ভেতর সিম সংযুক্ত একটি মোবাইল সেট খুঁজে পায়। তখন বায়ার প্রতিষ্ঠান আদিলা অ্যাপারেলসকে বিষয়টি জানালে গত ১৬ নভেম্বর আদিলা অ্যাপারেলসের কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন সদরঘাট থানায় মামলা দায়ের করেন।
১৭ নভেম্বর ভোরে নগর ও হাটহাজারী থানার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. কাওসার হোসেন (৩০), সাজ্জাদ হোসেন (২৬), শাহাদাত হোসেন (২৯) ও আনোয়ার হোসেন (২৯) নামে চারজনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এদিকে ১৮ নভেম্বর নগরের বন্দর এলাকায় কাভার্ডভ্যান থেকে রফতানি পণ্য চোরাই চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেফতার দুইজন হলেন-শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার থিরোপাড়া এলাকার আবদুল মজিদের ছেলে মো. কাশেম (৪৩) ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হাজিপাড়া এলাকার মো. আবদুল লতিফের ছেলে মো. রাশেদ (২৮)।
তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান, নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা বিভাগ) এস এম মোস্তাইন হোসাইন। তিনি বলেন, সড়কে অমরা প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছি। এ পর্যন্ত যারা ধরা পড়েছে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা অভিযান চালাচ্ছি। এছাড়া এ ধরনের আরো কিছু চক্রের সন্ধানে অভিযান অব্যাহত রাখার কথা জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম চেম্বার কমার্স এন্ড ইন্ড্রাট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কাপড় চুরির ঘটনা পোশাক খাতের জন্য অসনিসংকেত। বিদেশে বাংলাদেশি পণ্য’র যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। দেশের তৈরী পোশাক বিদেশে রপ্তানী করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করছে। এক্ষেত্রে এখাতকে বাচাতে হলে চুরির হাত থেকে পণ্যগুলো রক্ষা করতে হবে। অন্যতায় বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখিন হবে দেশীয় শিল্পখাত।
সক্রিয় সব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা না গেলে তৈরী পোশাক লিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আরিফুর রহমান রুবেল। তিনি বলেন, যারা ধরা পড়ছে তারা যেন আইনের ফাক ফোকড় দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। তাছাড়া আরো যারা এ অপরাধের সাথে জড়িতে তাদের যাতে ধরা হয়।
নির্বাহী সম্পাদক