Home » বিছানায় শুয়ে অন্যের রক্ত মিলিয়ে দিয়ে দিন কাটে মোহাই মিনুর

বিছানায় শুয়ে অন্যের রক্ত মিলিয়ে দিয়ে দিন কাটে মোহাই মিনুর

মোহাই মিনুর রহমান মিম। শরীরের নিচের অংশ আকস্মিকভাবে অক্ষম -অবশ হয়ে যায় ২০১২ সালের শেষভাগে। থেমে যায় চঞ্চল-চপল জীবনযাপন। কিন্তু নিজের আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন অন্যভাবে। সারাদিন বিছানায় শুয়েই সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করে দেন। সারাদিন একই কাজ। বাসায় আর কোনো কাজ নেই। আসুন মিমের মুখেই শুনি তার সবটুকু গল্প-

২০১২ তে হঠাৎ চোখে এলো ‘Donate Blood/রক্ত দিন, জীবন বাঁচান” নামের একটি রক্তের পেইজ! প্রতিনিয়ত সেখান থেকে রক্তের অনুসন্ধানের পোস্ট দেয়া হয় আর অপরিচিত মানুষের মাঝ থেকে কেউ গিয়ে রক্ত দিয়ে আসে। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে। এডমিন ‘ব্লাড চাই’ বলে পোস্ট দিত আর আমি সেই পোস্ট গুলো দেখে দেখে টুকটাক ডোনার যোগাড়ের চেষ্টা করতাম। অসহায় রোগীদের স্বেচ্ছায় সাহায্য করার ব্যাপারটা ধিরে ধিরে নেশার মত হয়ে যায়। এদিকে আমি নিজেও একজন রোগী। তাই হাসপাতাল, রক্ত, অপারেশন এবং ওইসব মুহূর্তে একটা পরিবারের কি রকম অসহায় অবস্থা যায় সে দৃশ্য আমার জানা। নিজের দিকটা সংক্ষেপে একটু বলছি তাহলে হয়ত আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারবেন, বুঝতে পারবেন কেন মানবতার কাজ গুলো আমাকে এত টানে।

২০১১ এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমার এইচ এসসি টেস্ট পরীক্ষা চলছে। শেষ পরীক্ষার ঠিক আগের দিন হঠাৎ পেটে ব্যাথা, জ্বর জ্বর লাগছে। শরীর খারাপ লাগায় দুপুরে খেয়ে ১ ঘণ্টার মতো ঘুমাই। এই মাত্র ১ ঘণ্টার ঘুম থেকে উঠেই দেখি আমি আর পা নড়াতে পারছি না! বাসার সবাইকে চিল্লিয়ে বলি কিন্তু কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না! আমাকে দু’জন ধরে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। নিউরোসার্জন বলেন এ কিছু না ওষুধ দিয়েছেন ঠিক হয়ে যাবে আর বেশি বেশি ডাবের পানি খেতে বলেন। আগামীকাল পরীক্ষা দিতে পারব বলে জানালেও গতদিনের রংপুর সরকারি কলেজ থেকে বাড়ি ফেরাটাই ছিল আমার জীবনের শেষ কলেজে যাওয়া।

ডাক্তারের কাছ থেকে আসার পর ভয়াবহভাবে পেট ফুলে যায়, কোমর হতে দুই পা পুরোপুরি অবশ! রাতে অবস্থার আরও অবনতি হলে ভোরে রংপুর মেডিকেল তারপর দ্রুত ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া হয়। মাঝ পথে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় সিরাজগঞ্জ খাজা ইউনুস আলী মেডিকেলের আইসিইউ তে এক রাত থেকে সকালে ভর্তি হলাম ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালে। তখন অবস্থা খুবেই খারাপ শুধু মাত্র শরীরের উপরের অংশ আর হাত দুটো নড়াতে পারি! এমনকি সেসময় পাশ ফিরতেও পারতাম না। হাসপাতালে থেকে ঢাকার অসংখ্য ডাক্তার দেখানো হয়, কয়েকবার MRI করানো হয়। চাচাতো বোনের সাহায্যে কোনো ডাক্তার চিকিৎসায় বিন্দুমাত্র কার্পণ্যও করেননি। সামনে এইচ এস সি টেস্ট পরীক্ষা থাকায় অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় দ্রুত সিঙ্গাপুর যাবার।

এবার কয়েকদিনের মধ্যে প্রয়োজন লক্ষ লক্ষ টাকার! জমি বিক্রয় সহ যত প্রকার চেষ্টা আছে কোনওটাই বাদ রাখেনি পরিবার। সেই অসুস্থতার প্রথম দিন থেকে সব কিছুই যেন খুব দ্রুত আর দুঃস্বপ্নের মত ঘটে চলছে। অবশেষে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হই ২০১২ এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। ওখানে মামা-খালামনি থাকায় যথেষ্ট সাপোর্ট দেন আমাদেরকে। ৬-৭ ঘণ্টা যাবত অপারেশন হয়! জানা যায় আমার স্পাইনাল কর্ডে (মেরুদণ্ড) কোনো কারণে ব্লিডিং হয়ে রক্ত জমেছিল। তবে বায়প্সি করে কিছু পাওয়া যায়নি। ডাক্তার পরামর্শ দেন ফিজিও থেরাপি। … দেশে ফিরলাম হুইল চেয়ারে করে।

এবার ১ বছর পর ২০১৩ এর আগস্টে ভেলরে (ইন্ডিয়া) গেলাম চেকআপ করাতে। ওখানেও ফিজিও থেরাপি করতে বলা হয়। ফিজিও থেরাপি রেগুলার চলছে একটু বসেত পারি তখন। আবার ২০১৫ এর সেপ্টেম্বরে চেন্নাই (ইন্ডিয়া) এ যাই চেকআপ করাতে। মামা ওখানে থাকায় ওনার আন্তরিক সাহায্যে বেশ কিছু ডাক্তার দেখাই। আবারও ফিজিও থেরাপির পরামর্শ দেয়া হয়। সেবার চেন্নাই তে স্টেম সেল থেরাপিও নিয়েছিলাম।

মাঝে বেশ কয়েকবার ঢাকায় গিয়েছিলাম। পপুলার হাসপাতাল, আনোয়ার খান হাসপাতাল সহ যখন যেই ডাক্তার পেয়েছি পরামর্শ নিয়েছি। ডাঃ মাসুদা শিখা অ্যান্টির সহযোগিতায় ঢাকায় ৯ মাস থেকে খুব আন্তরিক একজন মানুষের কাছে ফিজিও থেরাপি করি।

সেই ১ম দিন থেকেই রেগুলার ফিজিও থেরাপি চলছে। বিগত কয়েক বছরের ফিজিও থেরাপিতে ধিরে ধিরে এখন কোমরে কিছুটা ব্যাল্যান্স আসছে, কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে পারি, খেতে পারি। অসুস্থতার ১ম দিন থেকে আজ পর্যন্ত কোমর থেকে নিচের অংশটা প্যারালাইজড হলেও মনোবল আর চেষ্টায় শরীরের উপরের অংশ দিয়ে সব কাজ করতে পারি। অন্যদিকে এর মাঝেই আরও দু’বার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেও পরীক্ষার আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় ভাগ্যে আর পরীক্ষা জোটেনি।”

তো জীবনের এত বড় গল্পটা এত সংক্ষেপে বলার পিছনের একটাই কারণ ছিল, হাসপাতাল, ডাক্তার, রোগী, অসুস্থতা, শব্দ গুলোর সাথে আমার সম্পর্ক কি সেটা বুঝাতে! এই সময় গুলোতে চিন্তা, হতাশা, অর্থের প্রয়োজন কিভাবে একটা পরিবারকে গ্রাস করে তা আমি জানি! আমি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করি একটা রোগী আর রোগীর পরিবারের হাসপাতালের দৃশ্য। বিভিন্ন হাসপাতালের বেডে শুয়ে দেখেছি অন্য রোগীদের রক্তের জন্য আর্তনাদ! জানি সেসময়ের সামান্য সাহায্যও কত উপকারে আসে! সিঙ্গাপুরে আমার অপারেশনেও রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল কিন্তু আমি জানিনা আমার রক্তদাতা কে! আমার শরীরে ভিনদেশী অচেনা মানুষের রক্ত ব্যাপারটা আমাকে প্রায়ই ভাবায় আর সেই ভাবনা থেকেই রক্ত খোঁজার কাজে নিজেকে এত জড়িয়ে ফেলা।”

পরবর্তীতে রক্ত খুঁজে দিয়ে দিয়ে ফেসবুক পেইজ এডমিন রুবায়েত ভাইয়ের সাথে পরিচয়। স্বেচ্ছায় অপরিচিত মানুষের জন্য রক্ত খোঁজার নেশা দেখে ২০১৩ জানুয়ারিতে রুবায়েত ভাই পেইজের এডমিন করে নেন আমাকে। ওনার হাত ধরেই ছিল শুরুটা। সেই থেকেই শুরু হয় পুরো দমে রক্ত খোঁজার নেশা! তখনও আমি ঢাকার সাভারে একটা হাসপাতালের বেডে শুয়ে। নিজে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতাম আর অপরিচিত অসহায় রোগী গুলোর জন্য রক্ত খুঁজতাম। ডাক্তার, নার্স ভাবত আমি হয়তো অর্ধ অনুভূতির শরীরটা নিয়ে সারাদিন ল্যাপটপে গেম খেলছি কিন্তু না, আমার সারাদিন রাতের কাজ পেইজের ইনবক্স থেকে রক্তের চাহিদা গুলো ফেসবুকে মানুষের কাছে প্রচার করা আর বুঝিয়ে বুঝিয়ে মানুষকে রক্তদানে উৎসাহী করা।”

এবার পরিচয় হয় শুভ ভাই, শোয়েব ভাই, শোভন ভাই, সেলিম ভাই, জনি ভাই, নিশান ভাইয়ের সাথে। ভালো একটা সার্কেল পেয়ে যাই! যুক্ত হয়ে পরি “রক্ত দিন, জীবন বাঁচান”, “Blood Donation Bangladesh” সহ অসংখ্য গ্রুপ পেইজের সাথে! সেসময়ের ফেসবুকের প্রায় সব রক্তদানের পেইজ গ্রুপের এডমিন প্যানেলে আসার পর আরও অসংখ্য মানবতা প্রেমী মানুষের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাজ্জাত ভাই, শাওন ভাই, সজিব ভাই, নজরুল ভাই, মামুন ভাই, মিথিলা আপু, ইলা আপু, লিমন ভাই, লিয়ানা আপু, সাবিহা আপু, এবায়েত ভাই, হিমেল ভাই, আকাশ ভাই, আসিফ ভাই, নির্ঝর, সাদ ভাই, ফাহিম ভাই, নুসরাত, ইমাম ভাই, মানিক ভাই, তিতির আপু, বাবু ভাই, তুষার ভাই, মশিউর ভাই, বাবুল ভাই, রাব্বি ভাই, বর্ষা আপু, আবির ভাই, মুক্তার ভাই, হাসান আব্দুল্লাহ ভাই, বীথি আপু, রাহুল ভাই, নাসির, রুবেল ভাই, ফয়সাল ভাই, তুহিন ভাই, নিশি আপু, ইউসুফ ভাই, হান্নান ভাই, অর্ণব, জগদিশ ভাই, বি করিম ভাই, চাঁদনী আপু, রঞ্জিত, জয় সহ আরও অনেকে!

নাম বলে শেষ করা যাবে না অসম্ভব ভালো মনের এই মানুষ গুলোর! শুধু সেই প্রথম দিকে পরিচয় হওয়া এত জনের নাম লিখতে গিয়ে হয়তো কার নাম ডাবল হয়েছে, কারো বা লিখছি ভেবে লেখা হয়নি! মূল কথা, অনলাইন ব্লাড ডোনেশনের এই প্লাটফর্মের অনেকের সাথেই একপর্যায়ে আমার পরিবার সম্পর্ক হয়ে যায়! ছোট ভাই,বন্ধুর মতো সবাই আগলে রাখে আমাকে। বছরের পর বছর চার দেয়ালের ঘরে থেকে থেকে কখনো হতাশায় ভুগলে আমাকে ভালোবাসায় পূর্ণ করে দেন এনারা। মূলত ভালোবাসার “call4blood” এর সাথে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে আরও কয়েকটা সংগঠনের কাজ খুব ভালো লাগে। সঞ্চারণ, স্পৃহা, প্রচেষ্টা, লাইটার স্বেচ্ছাসেবী/পথশিশুদের সংগঠন সহ বাকি আরও কিছু ব্লাড সংগ্রহের সংগঠন গুলোয় খুব বেশি কাছের মানুষরা থাকায় সব মিলে আমাদের একটা পরিবার মনে হয়।”

আমার নেশা হাসপাতালে ছটফট করা রোগী গুলোর জন্য রক্ত যোগাড় করা। সে খাতিরে পরবর্তীতে অনলাইনের আরও অনেক মানবতা প্রেমী মানুষের সাথে পরিচয় হয়। কে কোন জেলার বা কে কোন সংগঠনের এসব না ভেবে যেখানেই যার জন্য রক্তের প্রয়োজন শুনেছি, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি। গত ৫/৬ বছরে নিজে কত ব্যাগ রক্ত যোগাড় করেছি সে হিসাব রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি কখনো কিন্তু সবার একক চেষ্টায় অনলাইনের এই প্লাটফর্মটা থেকে দেশের বড় একটা অংশের রক্তের চাহিদা পূরণ হচ্ছে প্রতিদিন। সবাই মিলে তিলে তিলে গরে উঠেছে এই মানবতার প্লাটফর্ম।”

একটা সময় ছিল সেই শুরুর দিকে যখন মানুষ রক্তদানের কথা শুনলে ভয় পেত! অপরিচিত রোগীকে রক্ত দিতে যাবার কথায় আঁতকে উঠত! কিন্তু সবার চেষ্টায় আজ দৃশ্যটা অনেকটা পালটেছে। সেই প্রথম থেকে যারা যুক্ত আছেন তারাই এই পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। এখন ফোনে/পেইজের ইনবক্সে রক্তের অনুরোধ আসলে তা আগের তুলনায় অনেক সহজে পাওয়া যায়। শুধু আমি এডমিন প্যানেলে থাকা সব গুলো পেইজ আর গ্রুপ মিলে সম্ভবত ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ ফেসবুকে সরাসরি রক্তদানের সাথে যুক্ত। এছাড়াও রয়েছে স্বেচ্ছায় রক্তদানে ইচ্ছুক এমন কয়েক হাজার মানুষের লিস্ট! এমন আরও অসংখ্য পেইজ গ্রুপ আছে যারা অনেকেই এভাবে মানুষকে রক্তের সন্ধান করে দিচ্ছেন। সবাই আমরা রক্ত যোগাড় করে দেয়ার নেশায় আসক্ত।”

দিন রাত বেডে শুয়ে শুয়ে সারাদেশের অপরিচিত মানুষের জন্য রক্ত খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে হঠাৎ মাথায় এলো, আচ্ছা ঢাকা চট্টগ্রামের মানুষের রক্ত প্রয়োজন হলে এত দ্রুত পাওয়া যায় কিন্তু রংপুরের নয় কেন? ভেবে দেখলাম রংপুরের ডোনার কম পেইজ গুলোতে তাই রেসপন্সও কম! এদিকে নিজের শহরটায় বের হতে পারতাম না বলে শুয়ে বসে ‘রংপুর বাংলাদেশ’, ‘আমাদের রংপুর’ ফেসবুক কেন্দ্রিক আঞ্চলিক পেইজ গুলোতে শহরে বিভিন্ন খবর আর স্থানের ছবি দেখতাম। দেখতাম নিজের স্কুল, খেলার মাঠ, হেঁটে চলা পরিচিয় জায়গা গুলো।”

এসব দেখে দেখেই চিন্তা করলাম এইসব পেইজে আমাদের রংপুরের সব মানুষ তাহলে আমি এখান থেকেই রংপুরের মানুষ গুলোর রক্তের চাহিদা খুব সহজে পূরণ করতে পারি! রংপুরের পেইজের এডমিন শুভ ভাইকে রক্ত যোগাড়ের এই প্ল্যান বলায় তৎক্ষণাৎ উনি রংপুরের সব থেকে পরিচিত আর পুরাতন পেইজ গুলোর এডমিন করে দেন আমাকে। এবার ২০১৩ এর জানুয়ারি থেকে শুরু সারাদেশের পাশাপাশি রংপুরের অসহায় রোগীদের জন্য রক্তের খোঁজ করা! পেইজ থেকে বারবার পোস্ট করে যাই “রংপুরের কারো রক্ত প্রয়োজন হলে আমাদেরকে জানান, আমরা চেষ্টা করব। কে কে স্বেচ্ছায় রক্তদানে ইচ্ছুক?

আমার মতো রংপুরের রক্তের সন্ধান করা অনেক ছোট-বড় ভাই/বোন, বন্ধু সবাই মিলে চলতে থাকে আমাদের রক্তের খোঁজ! এখানে পরিচয় হয়েছে আরও এক ঝাঁক মানব প্রেমী ছেলে মেয়ের সাথে! সবার রক্তদানের ব্যাপারে এত উৎসাহ, অসহায় মানুষকে সাহায্য করার এত ইচ্ছে যা বলে বোঝানোর মতো না! কেউ কেউ তো আবার অসহায় রোগীকে নিজে রক্ত দেয়ার বা খুঁজে দেয়ার পাশাপাশি রক্তের ব্যাগ কেনার টাকাটাও দিয়ে আসেন! রক্তদানের প্লাটফর্মে আমরা রংপুরের সন্তানরা সব এক সাথে। রংপুরের মানুষ এখন রক্তদান শব্দটার সাথে অনেক পরিচিত, অনেক সচেতন! এখন খুব সহজেই সবার সহযোগিতায় অন্যান্য বিভাগের মত রংপুরেও ফেসবুক থেকে রক্তদাতা পাওয়া যায়।

এই হলো আমার রক্ত, হাসপাতাল, রোগী, দুঃসময় এসবের সাথে জড়িয়ে থাকার গল্পটা! বলতে গেলে নিজের দিন রাতের রুটিন আমার এমনটাই। বেডে শুয়ে বসে সামনে মনিটর, বুকের উপর কিবোর্ড নিয়ে এভাবেই কাটে সারা বেলা। এর ফাকেই কখনো নিজেও অসুস্থ হয়ে যাই! সেই ছোট বেলা থেকে ডাক্তার হবার খুব বেশি স্বপ্ন থাকলেও এখন শুধুই একজন রোগী হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি থাকি। ডাক্তার টেস্ট এসব করে আবার মানুষের জন্য স্বেচ্ছায় রক্ত খুঁজি। এলাকা, পরিচিত মহলের অনেকেই জানে এই কাজটা আমার নেশার মত তাই কারো রক্তের প্রয়োজন হলেই স্মরণ করেন। সেসময় অন্তত চেষ্টা করতে পেরেও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

একটা কথা বলা হয়নি আমার বা আমাদের কাজটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। Call4Blood বা Blood Donation Bangladesh শুধু মাত্র রক্তদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখে। ইন্টারনেটে আমাদের নাম্বার দেখে রোগীর আত্মীয়রা ফোন দিয়ে রোগীর সমস্যা, হাসপাতালের নাম, ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ ও ফোন নাম্বার জানায় আমরা প্রাথমিক অবস্থায় এই বিস্তারিতটা রক্তের পেইজ/গ্রুপে পোস্ট করি আর সেই পোস্ট দেখে ঐ রক্তের গ্রুপধারি কেউ সরাসরি রোগীর আত্মীয়ের দেয়া নাম্বারে যোগাযোগ করে রক্তদান করে আসে। আমরা আপডেট করে দেই আমাদের কাজ এতটুকুই!

আর তারপর দুর্লভ গ্রুপের রক্ত গুলো পাওয়া না গেলে আমরা ডোনার লিস্ট থেকে ডোনারদের ফোন দিয়ে রক্তদানের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করি। এইসব রক্তদানে রক্তদাতা ও রক্তগ্রহিতা উভয়েই আমাদের অপরিচিত। রোগীর রক্ত যোগাড়ের ক্ষেত্রে আমাদের কোন প্রকার আর্থিক লেনদেন নেই। আমাদের এখানে কেউ ছাত্র, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকুরীজীবী, কেউবা বেকার, সবাই নিজের সময়, অর্থ ও শ্রম দিয়ে শুধু মাত্র আত্মতৃপ্তি আর মনবতার জন্য এই কাজ গুলো করে থাকি। তবে বন্যার্তদের সাহায্য, শীতবস্ত্র ও ঈদে এতিম বাচ্চাদের জন্য আমরা সকলে মিলে সাহায্য দিয়ে ও পরিচিত মহলের সাহায্য নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। প্রতিবছরের নেয় এবারও ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ এ Call4Blood কুড়িগ্রাম নাগেশ্বরীতে “বিজয়েরর মাসে উষ্ণতার হাসি” ইভেন্টের মাধ্যমে ১১৩০ টি কম্বল বিতরন করে।

সব শেষে যেটা বলার, নিজের যে দুটো পা থেকেও নেই সেটার গল্পটা আগে কখনো কাউকে এভাবে পুরোপুরি বলতে চাইনি কারন আমি নিজেকে সাধারণ আর দশজন মানুষের মত ভাবতে পছন্দ করি। অনেক ইভেন্ট, অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকি যেন আমি “অসুস্থ” ভেবে মানুষ সহানুভূতির চোখে না দেখে। অনেক রোগীর রক্ত যোগাড় করে দেয়ার পর যখন ধন্যবাদ দিয়ে জানায় দেখা করবে তখন সুযোগে আড়াল হয়ে যাই। যখন কোন রোগীকে দিনের পর দিনে রক্ত খুঁজে দেয়ার পরও বিধাতার লেখা অনুযায়ী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তখন রোগীর আত্মীয় জানাজায় শরীক হতে বললে ছোট্ট করে “আচ্ছা” বলে দূরে সরে আসি।

আমি কখনো চাইনি জানাতে রক্তের পেইজ গুলোর আড়ালে আমি কেমন আছি, রক্তের সন্ধান করে চলা ফোন নাম্বারটার এপাশে আমার দিন গুলো যায় কিভাবে! এই লেখাটা পড়ার আগ পর্যন্তও অনেকেই জানত না আমি এরকম অসুস্থ। ছোট্ট একটা গল্প বলতে গিয়ে আজকে একটু একটু করে নিজের এত গুলো না বলা কথা বলে ফেললাম! কেননা এটাই আমার রক্তের সন্ধান করে চলার গল্প! নিজের জীবনের সাথে অসহায় রোগীদের মিল খুঁজে পাবার গল্প! আমার নেশা, আমার ভালোলাগা। আমি বুঝি একেকটা রোগীর কস্ট।”

এ কাজে শুরু থেকেই যথেষ্ট সাপোর্ট করেন আমার বাবা মা। তাঁরা রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার সব কিছু কিনে দেন আর আমি ঘরে বসেই আশেপাশের মানুষের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে দেই, রক্তদানে উদ্ভূত করি। আমার মা খুব করে উৎসাহ দেন যেকোনো মানবতার কাজে। পরিচিতদের এমনটাও বলেন- রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করলে কোক খাওয়াবে আর তাঁকে জানিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে আসলে বিরিয়ানি খাওয়াবে।”

… রক্তদানে আসার গল্পটায় নিজের গল্প জড়িয়ে থাকায় আজ অনেকদিন পর চোখ ভিজে গেল। সবাই আমার জন্য শুধু দু’আ করবেন। এটা ছাড়া জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই। শুধু স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট, পড়া আর সাইকেলিং এর মাঝে কাটানোর জীবনে হঠাৎ অসুস্থ হবার পর যে এত ভালো একটা মানবতার পৃথিবী দেখব, এত এত সব ভালো মানুষের সাথে পরিচয় হব সেটা কখনো কল্পনাও করিনি! মাঝে মাঝে মনে হয় বাস্তব জীবনের আর ফেসবুক জীবনের ভালোবাসায় মানুষ গুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই! কখনো মনে হয়না এখানের কেউ পরচিত ছিল একসময়! সব মিলে নিজেকে কখনো একা মনে হয়নি। অনলাইনের মানবতার জন্য কাজ করা এই ভাই-বোন গুলোর আর আশে পাশের বন্ধুদের সবার ভালোবাসায় বাঁচি আমি। রক্তের ডাক যেন রক্তে মিশে গেছে।”

মোহাই মিনুর রহমান মিম, শালবন, রংপুর

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *