ঢাকাঃ সম্প্রতি কোটাভোগীদের নিষ্ঠুর আক্রমণে কোটাসংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। বহু ছাত্রছাত্রী আহত ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে প্রচলিত ৫৬ভাগ কোটার মধ্যে ৩০ভাগই মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগী। ন্যাক্কারজনক হামলার শক্তি তাদেরই আছে। অন্য কোটাভোগীদের তা নেই। বর্তমান সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে প্রশাসনের অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধাকোটার গোঁড়া সমর্থক।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটা ব্যতিত অন্যান্য সকল কোটা বাতিলের প্রস্তাব করেছেন। বিচারবিভাগ থেকেও মুক্তিযোদ্ধাকোটা বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীদের শক্তির উৎস, একটি আলোচিত বিষয়।
৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটা পরিপালনের জন্য বাংলাদেশে একটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। প্রতিবছর জাতীয় সংসদ থেকে এতে হাজার হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়। এ অর্থ ভোগ করে মাত্র প্রায় ২লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণেও ব্যয় হয়। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাকোটা জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। সরকার বিগত কয়েকবছর এ কোটা পরিপালনে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর এযাবত দেশের সকল নিয়োগে ৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটা পরিপালনে যেটুকু ব্যত্যয় ঘটেছে, তা শতভাগ পুরণ করেছেন। যেমন ধরুন, কোনো প্রতিষ্ঠানে এযাবত ১০০০ নিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটায় ৩০০জন নিয়োগের কথা। হয়তো ২০০পদে ব্যত্যয় ঘটেছে। বর্তমানে উক্ত প্রতিষ্ঠানে আরো ২০০পদ খালি হয়েছে। এতে ৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটায় ৬০পদ ও ব্যত্যয়ঘটিত ২০০পদ মিলে সম্পুর্ণ নিয়োগপ্রক্রিয়া শুধু মুক্তিযোদ্ধাকোটায় সম্পন্ন হয়েছে। এভাবে বিসিএস, ব্যাংক ও অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাকোটায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এতে দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীদের প্রাধান্য বেড়েছে। ২লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা থেকে এদের কোটা সুবিধাভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০লাখে। তারা দেশের গুরুত্বপুর্ণ জনশক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
অথচ স্বাধীনতাযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস পর্যালোচনায় কোথায়ও মুক্তিযোদ্ধাকোটার অস্তিত্ব নেই। স্বাধীনতার স্থপতি বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ছিলনা। মুক্তিযোদ্ধাভাতা বা কোটার প্রশ্নও ছিলনা। তখন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছিলনা। বঙ্গবন্ধু তাঁর সকল ভাষণ ও কর্মকান্ডে তৎকালিন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে একীভূত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য শুধুমাত্র ৬৭৬ যোদ্ধাকে বিশেষ খেতাব প্রদান করেছেন। ঘোষিত ৩০লাখ শহীদের পক্ষ থেকে ৭জনকে বীরশ্রেষ্ঠ এবং সকল যোদ্ধা, বন্দী, আত্মত্যাগী ও সহযোগী বীর বাঙ্গালির পক্ষ থেকে ৬৬৯ জনকে (বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতিক) খেতাব প্রদান করেছেন। তিনি দেশের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর শহীদ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ৩০লাখ শহীদ ও অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, তাদের জন্য ভাতা বা তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য কোটা চালুর চিন্তাও তিনি করেননি। এজন্যই তিনি বাঙ্গালি জাতির পিতা হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদগণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করেন। তারা বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ বর্জন করে সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালির পরিবর্তে নিজেদের পছন্দমত মাত্র প্রায় ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করেন। তালিকাভুক্তদের জন্য ভাতা ও তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য কোটা চালু করেন। জাতীয় সংসদ থেকে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেন। কোটাসংস্কার আন্দোলনে পাশবিক হামলার মতো যেকোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তাদের লেলিয়ে দেন। সরকার এখন দেশের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের অধীনে কমপক্ষে ৪/৫টি পরিবারকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসুবিধা প্রদান করেছেন। কোটাভোগীরা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে জীবনের বিনিময়ে হলেও সরকারের পক্ষে ভোটকেন্দ্র দখলে রাখবেন। তাই কোটাভোগীরা সরকারের কাছে প্রশাসনের চেয়েও গুরুত্বপুর্ণ শক্তি বিবেচিত হয়েছেন।
দেশের কোটাবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্টির কাছে কোটাভোগীদের উল্লেখিত শক্তি ও দাপট নিছক বালির বাঁধ। বঞ্চিত ছাত্রসমাজ কোটা বৈষম্যের বিরূদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করলে, ১২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে সকল কোটা বাতিলের ঘোষণার ন্যায় তাৎক্ষণিক তা বাতিল হবে। তখন কোটাভোগীদের সকল শক্তি চুর্ণ হবে।
নির্বাহী সম্পাদক