Home » সিলেট নগরীর যুবলীগের চিড়িয়াখানা এখন স্বেচ্ছাসেবক দলের কবজায়

সিলেট নগরীর যুবলীগের চিড়িয়াখানা এখন স্বেচ্ছাসেবক দলের কবজায়

সিলেট নগরীর টিলাগড় এলাকায় সংরক্ষিত বনের প্রবেশ মুখের অংশটি সিলেট বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র। বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় এটি ইজারা ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো। ইজারাদার ছিলেন সিলেট মহানগর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুবেদুর রহমান মুন্না। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টিকিট আদায়ের কাজ দাপটের সঙ্গে করা হতো বলে এটি ‘যুবলীগের চিড়িয়াখানা’ হিসেবে পরিচিত ছিল। তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ইজারাদারও ছিলেন দাপুটে। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেই দাপুটে ইজারাদারির ইতি ঘটে। ইজারাদার লাপাত্তা হওয়ায় প্রাণীর নিরাপত্তাহীনতায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি।

সম্প্রতি বন বিভাগের মাধ্যমে যুবলীগের চিড়িয়াখানার দায়িত্ব নিয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা। যুবলীগ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দলে কর্তৃত্ব বদল হওয়ার বিষয়টি জানান দিতে সেখানে আয়োজন করা হয়েছে বৈশাখী মেলার। ‘এবার বৈশাখী মেলায় সিলেট ইকোপার্কে স্টল বরাদ্দ চলছে!’ ফেসবুকে এ রকম একটি পোস্ট দিয়ে স্টল বরাদ্দদাতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এরপর ‘ফেসবুক লাইভ’ করার মধ্য দিয়ে চলে বৈশাখী মেলার স্টল বরাদ্দ। এ আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কথা বলা হলেও মূল উদ্যোক্তা লাহিন চৌধুরী। তিনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য।

‘এবার বৈশাখী মেলায় সিলেট ইকোপার্কে স্টল বরাদ্দ চলছে!’ ফেসবুকে এ রকম একটি পোস্ট দিয়ে স্টল বরাদ্দদাতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পরপরই সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য লাহিন চৌধুরী তার অনুসারীদের নিয়ে বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ কেন্দ্রের দখল নেন। পরে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে একটি গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে লাহিন চৌধুরীসহ তিনজন ইজারা বন্দোবস্ত নিয়েছেন। তিন বছর মেয়াদে ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় গত ২৮ মার্চ ইজারা বন্দোবস্তের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এর পরই স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা লাহিন চৌধুরী তার ফেসবুক আইডিতে বৈশাখী মেলায় স্টল বরাদ্দের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার সপ্তাহ দিন পর স্টল বরাদ্দ দিতে গত সোমবার ‘ফেসবুক লাইভ’ আয়োজন করা হয়। এতে দেখা গেছে, সংরক্ষণ কেন্দ্রে যত্রতত্র স্থাপনা স্থাপন করে স্টল বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় তিন বছর ধরে সিলেট বন বিভাগের টিলাগড় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রটি ব্যবস্থাপনার জন্য ইজারা নিয়ে পরিচালনা করছিলেন যুবলীগ নেতা সুবেদুর রহমান মুন্না। তখন রাজনৈতিক দাপট খাটিয়ে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র ও ক্যাফেটেরিয়া ইজারা নিয়েছিলেন। ইজারা নিয়ে শুধু নিজেদের ব্যবসার দিকটিই নজর রেখেছিলেন। তার লোকজন সংরক্ষণ কেন্দ্রে রক্ষিত প্রাণীদের তদারকির গুরুত্ব দেয়নি। তার প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নেওয়ার পর সংরক্ষণ কেন্দ্রের দুটি জেব্রা, পাঁচটি ময়ূর, ১১টি কই কার্প মাছ, চারটি খরগোশ মারা গেছে। টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য দাবি, দর্শনার্থীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগও ছিল ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

যুবলীগ নেতা সুবেদুর রহমান মুন্না গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান। এর পর থেকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা ইজারাদারের নিয়োগ করা কর্মীরাও কাজে যাচ্ছেন না। এতে বিপাকে পড়ে বন বিভাগ। জনবলসংকট থাকায় ৪৫ দশমিক ৩৪ হেক্টর জায়গা ও বন্য প্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছিলেন মাত্র তিনজন।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রাণীদের জন্য নির্ধারিত খাঁচাগুলোর অবস্থা বেহাল। ময়ূরের খাঁচার ওপর গাছের পাতা ও বৃষ্টির পানি জমে পচে গেছে। কই কার্প মাছ রাখার জন্য নির্মিত ‘পুলে’ ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল। টানানো নেটে জমেছে গাছের ঝরা পাতা। তিনটি পাখির খাঁচা খালি পড়ে রয়েছে। সেগুলোর ভেতরে জন্মেছে লতাগুল্ম। প্রাণীদের খাবার তৈরির জন্য রাখা শেডটির টিনের চালা নষ্ট হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থার মধ্যে কেন্দ্রের দুটি জেব্রা মারা যাওয়ায় জেব্রার জন্য নির্ধারিত স্থানটি খালি রয়েছে। জেব্রার শেডের সামনে গরু চরে বেড়াতে দেখা গেছে।

প্রাণীদের তদারকি করা এক কর্মচারী জানান, তিন বছর আগে প্রথম ইজারা নেওয়ার সময় রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইজারাদার ২৯ জন কর্মী নিয়েছিলেন। পরে কমাতে কমাতে দুই মাস আগেও ১২ জন দায়িত্ব পালন করছিলেন। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রাণী তদারকির চেয়ে দর্শনার্থীদের টিকিট বিক্রিতে বেশি ব্যস্ত থাকতেন।

দর্শনার্থীরা খাঁচায় রক্ষিত প্রাণীদের অযথা বিরক্ত করার পাশাপাশি মানবখাবার দিয়ে প্রাণীদের অসুস্থ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু ইজারাদার এসব দেখতেন না। বন বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইজারাদার পালানো ও নতুন ইজারাদার ব্যবস্থাপনায় এখন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সত্ত্বেও অনেকেই বনের ভেতরে প্রবেশ করছেন, প্রাণীগুলোকে বিরক্ত করছেন। এ অবস্থায় মেলা হলেও পরিস্থিতি বেসামাল হবে।

সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) দপ্তর থেকে জানানো হয়, গত ২৮ মার্চ এটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। লাহিন চৌধুরী ইজারাদাতাদের একজন বলে নিশ্চিত করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ফোনে যোগাযোগ করলে লাহিন চৌধুরী খবরের কাগজের কাছে দাবি করেন, এটা বৈশাখী মেলা নয়, মূল ফটকের সামনে কয়েকটি স্টল দিয়ে চিড়িয়াখানার দিকে দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য এ আয়োজন। তাহলে ফেসবুকে বৈশাখী মেলা প্রচার দিয়ে স্টল বরাদ্দ কেন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে ভুল করে দেওয়া হয়েছিল। এগুলো সরানো হয়েছে এখন।’

রাজনৈতিক দাপটে ইজারাদারির কারণে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের অবস্থা এমন হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন পরিবেশ ও প্রাণী অধিকারভিত্তিক সংগঠন ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়ক মোহাম্মদ আশরাফুল কবির। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর খবরের কাগজে ‘পালিয়েছে ইজারাদার, ঝুঁকিতে বন সংরক্ষণকেন্দ্রের ৪৪ প্রাণী’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি রাজনৈতিক ইজারাদার না দিতে বন বিভাগের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন।

তার ভাষ্য ছিল, ‘প্রাণীদের প্রতি মায়াহীন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া অনুচিত। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দাপটে ইজারাপ্রথা পরিহার করা উচিত।’ কিন্তু পটপরিবর্তনের পর একই পন্থা অনুসরণ করায় হতাশ আশরাফুল বলেন, ‘এখন তো দেখছি স্বেচ্ছাসবেক দলই যুবলীগের ভূমিকায়। এ জন্য সংরক্ষিত বনে ব্যবসা করতে বৈশাখি মেলা বসানো হয়েছে।’

সংরক্ষিত এলাকায় বৈশাখী মেলার বৈধতার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের সহকারী বন সংরক্ষক মোহাম্মদ নাজমুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ কেন্দ্রটি একটি স্পর্শকাতর স্থান। এটি মূলত সংরক্ষিত বন। সংবেদনশীল ও সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় এখানে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা যাবে না। আমরা বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি। এ ব্যাপারে সরেজমিন গিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সূত্র: খবরের কাগজ

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *