ডেস্ক রিপোর্ট : সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে বিএনপি-জামায়াত। মূলত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জামায়াত ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্ত না মানায় তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পর এই বিরোধ সৃষ্টি হয়।
এদিকে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে লন্ডন থেকে টেলিফোনে জামায়াত শীর্ষ নেতাদের অনুরোধ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান। কিন্ত জামায়াত তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তারেক রহমানের পর জোটের শরিক দলের অন্য নেতাদের অনুরোধও রক্ষা করেনি তারা। সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের এই টানাপড়েন শুরু গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে।’
আবার রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদ নিয়ে সমঝোতা হলেও জামায়াত ওই দুই সিটিতে কমিশনার পদে জোটের বাইরে নিজেদের দলীয় প্রার্থী দিয়েছে। এ নিয়েও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। আবার সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে রাজি নয় বিএনপিও। বিএনপির একাধিক নেতা এবং জোটের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সব কিছু মিলিয়ে ২০ দলীয় জোটের সম্পর্কে চিড় ধরার আশঙ্কা করছেন নেতারা।’
জোট নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, গত বুধবারের বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, তারেক রহমান জামায়াত নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন সিলেটে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে। জামায়াত সে কথা রাখেনি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে। আলোচনার একপর্যায়ে জোট নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, অতীতেও জামায়াত কোনো প্রার্থী পায়নি, এবারও পাবে না। জোটের আরেক শীর্ষ নেতা আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন,আমরা জোটের একক প্রার্থী দেখতে চাই। জোটের অন্য নেতারাও জামায়াতকে একই অনুরোধ জানান। কিন্ত জামায়াতের প্রতিনিধি আব্দুল হালিমের সাফ জবাব, ‘সাংগঠনিক অবস্থান ধরে রাখতে তাদের ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই, তারা ভোটে থাকবেন। সংবাদ সম্মেলনে জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান ও মির্জা ফখরুল বলেন, প্রার্থী নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে টানাপড়েনের প্রশ্নই আসে না। বরং তিন সিটিতে একক প্রার্থী থাকবে। কিন্ত ওই দিন রাতেই জামায়াতের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, সিলেটে জামায়াতের প্রার্থী রয়েছেন। এতে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।’
এ প্রসঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২০ দলীয় জোটের একজন করে প্রার্থী থাকবেন এবং সবাই সেই প্রার্থীর জন্য কাজ করবেন। এটা বলা হয়নি যে তিন সিটিতে বিএনপির প্রার্থী থাকবে। কাজেই এতে কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।’
জোটের এক নেতা বলেন, বুধবারের বৈঠকে সবার অনুরোধের পর জামায়াত নেতা বলেছেন, তাঁরা ১২টির মধ্যে একটি সিটিতে মেয়র পেতে পারেন না? সিলেটে তাঁদের প্রার্থী অনেক ভালো। শরিক দলগুলোর মধ্যে একাধিক নেতাও জামায়াতের পক্ষে কথা বলেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে ওই নেতা জানান, জামায়াতের পক্ষে বলা দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী পার্টি, ন্যাপ-ভাসানী, খেলাফতে মজলিশ, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামীসহ সাতটি দল।’
এই পরিস্থিতি উদ্ভব কোথায়—এমন প্রশ্ন ছিল বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা ও জোটের শীর্ষ কয়েকজন নেতার কাছে। তাঁরা সবাই বলেছেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকেই এ সমস্যার শুরু। ওই সময় জামায়াত প্রার্থী দিয়েছিল এস এম সানাউল্লাহকে। জোটের নেতৃত্বে থাকা বিএনপিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, গাজীপুরে ছাড় দিতে। তাতে বিএনপি রাজি না হওয়ায় বরিশাল, রাজশাহী বা সিলেটের যেকোনো একটিতে ছাড় দেওয়ার কথা বলে রেখেছিল। ওই পরিস্থিতিতে বিএনপি , হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোনো জবাব দেয়নি।’
এদিকে রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে প্রচারণার জন্য তিনটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে ২০ দলীয় জোট। যাতে জায়গা হয়নি জামায়াতে ইসলামীর।’
সিলেটে দলের বিদ্রোহী নিয়ে আশায় থাকলে জামায়াতকে নিয়ে হতাশ বিএনপি : সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদ নিয়ে এখনো বিএনপির দুশ্চিন্তা কাটেনি। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে কিছুটা আশাবাদী হলেও শরিক দল জামায়াতের প্রার্থিতা নিয়ে রীতিমতো হতাশ দলের শীর্ষ নেতারা। স্থানীয়ভাবে একটা সমঝোতার চেষ্টায় গতকাল সিলেট ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে বিএনপি একটি সভা ডাকলেও জামায়াত তাতে যোগ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এতে করে শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হতে চলেছে।’
সিলেট সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সদ্য সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু তাঁর পথের কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছেন দলের মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। তিনি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেয়র পদে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতও নিজেদের প্রার্থী হিসেবে মহানগর জামায়াতের আমির এহছানুল মাহবুব জুবায়েরকে সমর্থন দিয়েছে। এ অবস্থায় রাজনীতির মাঠে বড় প্রতিপক্ষ সরকারদলীয় প্রার্থীকে মোকাবেলা করার চেয়ে নিজ দল ও জোটকে মোকাবেলা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপির।’
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের বিদ্রোহী প্রার্থী শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্ত মেনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবেন, এমনটিই তাঁরা আশা করছেন। এদিকে বিএনপির মেয়র প্রার্থীকে ২০ দলীয় জোটের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে গত ২ জুলাই বিএনপির সঙ্গে স্থানীয় ২০ দলীয় জোটের একটি সভা হয়েছিল। কিন্তু সেদিন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি তারা। এ অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে নগরের একটি কমিউিনিটি সেন্টারে আবারও জোটের বৈঠক ডাকেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু সেই সভায় যেতে অপারগতা প্রকাশ করে জামায়াত।’
সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির ও দলের মেয়র প্রার্থী এহছানুল মাহবুব জুবায়ের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি ২০ দলীয় জোটের বৈঠক ডাকলেও জামায়াত এতে অংশ নিচ্ছে না এটা নিশ্চিত। তিনি বলেন, ‘মেয়র পদে নির্বাচন থেকে তাঁর সরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’ এ ছাড়া সিলেটে ২০ দলীয় জোটের মেয়র প্রার্থী কে সেটি এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এ অবস্থায় সিলেটে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা আদৌ হবে কি না, সেটি আর নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’
রাজশাহীতে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টায় বুলবুল : রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে ঘোষণা দিয়ে মেয়র পদে জামায়াত প্রার্থী না দিলেও ১৬টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়েছে তারা। এর মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ডে ১৪টি ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে দুটি। এখন কাউন্সিলর পদে বিএনপিকে ছাড় দিতে চাপ দিচ্ছে জামায়াত। কাউন্সিলর পদে ছাড় না দিলে মেয়র পদে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে ছাড় দেবে না তারা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। এমনকি আগামী দিনে তাঁরা বিএনপির কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন কি না তা নিয়ে সংশয়ে আছেন। জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা বলছে, বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে লাভ কী? নির্বাচনের দিন বিএনপির কজন নেতাকর্মী মাঠে থাকে এখন তা দেখার অপেক্ষায় আছে তারা। এ ছাড়া দলের পক্ষ থেকে বুলবুলকে সমর্থন দিতে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাই বুলবুল কোনোক্রমেই জামায়াতের সমর্থন পাচ্ছে না বলেও জানা গেছে।’
বরিশালে কাউন্সিলর নিয়ে বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্ব : বরিশালে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে মেয়র প্রার্থী নিয়ে সমঝোতা হলেও দুটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূল বিএনপি বলছে, মেয়র পদে সরোয়ারকে ছাড় দেওয়ায় দুটি ওয়ার্ডে জামায়াত প্রার্থী দিলেও তাঁদের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, দুটি ওয়ার্ডে ২০ দলীয় জোট তাদের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবে। এ নিয়ে সমঝোতাও হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ নিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি ২০ দলীয় জোট।’
বরিশাল সিটি নির্বাচনে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ছয়টিতে বিএনপির বর্তমান কাউন্সিলর প্রার্থীর বিপরীতে দলীয় নেতাকর্মীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। অন্যদিকে পাঁচটি ওয়ার্ডে বিএনপি প্রার্থীরা সংকটে পড়েছেন। এর মধ্যে বিএনপিশূন্য দুটি ওয়ার্ডে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছে। আর দুটি ওয়ার্ডে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতও প্রার্থী দিয়েছে।’
বিএনপির প্রার্থী অ্যাভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, যেসব ওয়ার্ডে একাধিক প্রার্থী রয়েছে, তাদের নিয়ে বসব। জামায়াত প্রসঙ্গে বলেন, যে দুটি ওয়ার্ডে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছে, সেখানে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর রয়েছেন। তাঁদের বাদ দিয়ে জামায়াতের প্রার্থীদের সমর্থনের বিষয়টি ভাবতে হবে।কালের কান্ঠ