তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তরুণ সমাজ তথ্যের স্রোতে ভাসছে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার সহজলভ্যতায় প্রতিদিন নানা তথ্য ও সংবাদে ঘুরে বেড়ান তারা। তবে এই সুবিধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভুয়া সংবাদ বা বিভ্রান্তিকর তথ্য গ্রহণের প্রবণতা— যা তরুণদের ভাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কীভাবে তরুণরা এই ফাঁদে পা দিচ্ছে এবং এ থেকে বের হওয়ার পথ কী—এই প্রশ্নই এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
ভুয়া সংবাদ প্রচারে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব
তরুণরা মূলত বিনোদন এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করলেও ধীরে ধীরে এটি তাদের সংবাদ জানার প্রধান উৎস হয়ে উঠছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব এবং টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে তারা যেকোনও বিষয়ের দ্রুত আপডেট পায়। এছাড়া অনলাইন ও ছাপা পত্রিকাগুলোও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের সংবাদ পাঠকদের কাছে পৌঁছায়। তবে এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে খবরের সত্যতা যাচাইয়ের তেমন সুযোগ থাকে না। ক্লিকবাইট শিরোনাম, বিভ্রান্তিকর পোস্ট এবং ভাইরাল মিমের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো সহজ হয়ে গেছে।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই কাগজের পত্রিকা পড়েন না। সামাজিক মাধ্যম ঘুরতে ঘুরতে তারা বিভিন্ন মাধ্যমে নিউজ দেখতে পান। তরুণদের মধ্যে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন, তারা যাচাই-বাছাই করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের পেজ থেকে সংবাদ পাঠ করেন। আবার সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী তরুণদের একটা অংশ বিশেষ কোনও গণমাধ্যমের অফিসিয়াল পেজ ফলো করেন না। সাজেশনে যা আছে তাই দেখেন। এক্ষেত্রে তারা কোন পত্রিকা থেকে সংবাদ পড়ছেন, সে ব্যাপারে সচেতন না।
অনেক ক্ষেত্রে অসচেতনতার কারণে তরুণরা কেবল শিরোনাম দেখে খবরের সত্যতা যাচাই না করেই তা বিশ্বাস করেন। অনেক তরুণ আবার মনে করেন, পরিচিত কেউ কোনও তথ্য শেয়ার করলে তা সত্য হতে বাধ্য। এদিকে ফেসবুক অ্যালগরিদম অনুযায়ী, ক্লিকবাইট শিরোনামের যেকোনও সংবাদ—তা সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক ব্যবহারকারীদের কাছে সেটি বেশি পৌঁছায়। ওই সব নিউজে বেশি লাইক এবং কমেন্টের কারণেও অনেক তরুণ তা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন।
সম্প্রতি গণমাধ্যমগুলোর সংবাদভিত্তিক কার্ড শেয়ারের ফলে তা বিশ্বাসযোগ্য সূত্র হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। তাই অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব কার্ডের নকশা নকল করে ভুয়া তথ্য ছড়ান—যা অনেক তরুণ বিশ্বাস করে শেয়ারও করে থাকেন।
বিভিন্ন অপরিচিত নিউজ পোর্টাল এবং ভুয়া কার্ডের লাইক ও কমেন্ট করা শতাধিক ব্যক্তির প্রোফাইল ঘুরে দেখা যায়—তাদের বেশিরভাগ প্রোফাইলে ঢাকার বাইরের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। এদের মধ্যে শিক্ষিত তরুণের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য।
তরুণদের কাছে গণমাধ্যমের চেয়ে বিভিন্ন ইনফ্লুয়েন্সারের ভিডিও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তারা ইনফ্লুয়েন্সারদের বক্তব্যকে গুরুত্ব সহকারে নেন। এক্ষেত্রে কোনও কোনও ইনফ্লুয়েন্সারের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য বা ঘৃণা ছড়ানোর নজিরও রয়েছে।
ভুয়া তথ্যের কারণে বাড়ছে বিভ্রান্তি
ভুয়া খবরের এই প্রবণতা তরুণ সমাজের মানসিকতা ও সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। ভুল তথ্য বিশ্বাস করে অনেক সময় তরুণরা সমাজে ভুল ধারণা ছড়াচ্ছে বা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। প্রায়শ বিভ্রান্তি ও মিথ্যা ক্যাপশনের কারণে সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পর্যন্ত জড়ানোর খবর পাওয়া যায়।
তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে ধরনের তথ্য তাদের মানসিকভাবে নাড়া দেয়, তা যাচাই ছাড়াই তারা শেয়ার করেন।
মিরপুরের বাসিন্দা মো. আরিফুল বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘যে সংবাদ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়, সেটাই আমি শেয়ার করি। নিউজের সোর্স খেয়াল করা হয় না।’
অনেক তরুণের মতে, সব গণমাধ্যম সব সত্য তথ্য দেয় না। তাই সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিসূত্রে পাওয়া বা শেয়ার হওয়া তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন তারা। এ বিষয়ে পল্টনের এক দোকানি সোহাগ ইসলাম বলেন, ‘সব খবর তো আর পত্রিকাতে আসে না। আর পত্রিকাগুলো নিজেদের স্বার্থের বাইরে কোনও নিউজ দেয় না। এর চেয়ে মানুষজন সামনে যা দেখে, তাই লাইভ দেয়, ওটাই সত্য মনে হয়।’
অনেক তরুণ আবার সংবাদ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সচেতনতা বজায় রাখেন। তারা পরিচিত নিউজ পোর্টাল ছাড়া কোনও সংবাদ পড়েন না। বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু ইহসান বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকলে কারও ভুল করার কথা না। আমরা যা দেখতে চাই, তাই দেখতে পাবো। আর এখন তো অনেক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা তৈরি হয়েছে। সেগুলোও ফলো করা যেতে পারে। এখন কেউ যদি এ বিষয়ে অজ্ঞ থাকে, তাহলে সে ইচ্ছে করেই সচেতন হচ্ছে না, বা সচেতন থাকলেও ইচ্ছে করে ভুয়া নিউজ ছড়ায়। আমাদের উচিত পরিচিত নিউজ পোর্টাল থেকে সংবাদ দেখা।’
সচেতনতার বিকল্প নেই, প্রয়োজন আইনের কঠোরতা
তরুণ সমাজকে সামাজিক মাধ্যমের ভুয়া তথ্য থেকে বিরত রাখতে সচেতনতার বিকল্প নাই বলে মনে করেন মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, তরুণ সমাজের জন্য ভুয়া সংবাদের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তরুণদের মাঝে সংবাদ যাচাই করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম ছাড়া তথ্য গ্রহণ বা শেয়ার না করার বিষয়ে তাদের গুরুত্বারোপ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বজুড়ে ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বাড়লেও তরুণদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তুলনামূলক কম। তারা যদি তথ্য যাচাইয়ের দিকে আরও মনোযোগী হয়, তবে ভুয়া সংবাদের প্রভাব কমানো সম্ভব। পাশাপাশি স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে মিডিয়া লিটারেসি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তরুণ সমাজ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হলেও তাদের মধ্যে ভুয়া সংবাদ গ্রহণের প্রবণতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা, সচেতনতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে সতর্কতা। তরুণরা যদি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে, তবে সমাজ আরও তথ্যনির্ভর এবং সুশৃঙ্খল হবে।’
চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, মানুষের মাঝে ৭০-৮০ ভাগ নেতিবাচক সংবাদ গ্রহণের মানসিকতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মানসিকতার কারণে সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশ্রিত তথ্য গ্রহণ করার প্রবণতা বেশি। এছাড়া অনেকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মিথ্যা ছড়ায়। আর এতে বেশি ক্লিক পড়ায় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের সামনে এগুলো বেশি আসে। এসব ক্ষেত্রে তরুণদের সচেতন হতে হবে। কারও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা সংবাদের ফাঁদে পড়া যাবে না।
সরকারের তরফেও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য অনেক সংস্থা থাকলেও সেগুলো সবার কাছে বেশি পৌঁছায় না। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ফ্যাক্ট চেকিং সাইট খোলা যেতে পারে। তা আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে। এছাড়া আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর দায়ে যদি গ্রেফতারের দৃষ্টান্ত বারবার দেখানো যায়—তাহলে ব্যবহারকারীরাও এ বিষয়ে সচেতন হবে। তারা ভুল তথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে চিন্তা করবে। এখন যেহেতু অনলাইনের যুগ, তাই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’