Home » পাঠ্যবইয়ের শেষে গেল জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকার ছবি

পাঠ্যবইয়ের শেষে গেল জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকার ছবি

একটি জাতির আত্মপরিচয়, আত্মগৌরব ও আত্মমর্যাদার অন্যতম চিহ্ন জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। জাতির সন্তানদের সেই গৌরব এবং পরিচয় অনুধাবনের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমার বাংলা বইয়ের শুরুতে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ছবি যুক্ত করা হতো।

তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার কথা জানানো হয়। তবে তেমন কোনো পরিবর্তন না থাকলেও প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আমার বাংলা বইয়ে জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার ছবি প্রথমে না দিয়ে বইয়ের শেষে যাচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে শিশুদের আত্মপরিচয়, আত্মগৌরব ও আত্মমর্যাদার শিক্ষা কতটা গুরুত্ব পাবে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা ও বই ছাপানোর কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রেস মালিকরাও। তারা বলছেন, এর আগে কখনো জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার ছবি বইয়ের শেষে দেয়ার নজির নেই।

এনসিটিবি কর্তৃক বিতরণ করা বিনামূল্যের বিভিন্ন বছরের পাঠ্যপুস্তকে ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতি বছরের বইয়ে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ছবি শুরুতে স্থান পেয়েছে। তবে হঠাৎ করে আগামী শিক্ষাবর্ষের বইয়ে কেন এমন পরিবর্তন হলো বিষয়টি নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি এনসিটিবির চেয়ারম্যান কিংবা সংশ্লিষ্ট সদস্য।তাদের ভাষ্য, কী পরিবর্তন হয়েছে এবং কেন হয়েছে এটার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পাঠ্যপুস্তক সংশোধন-পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি ভালো জানেন। জানা গেছে, সমন্বয় কমিটিতে বাংলা বিষয়ে সদস্য হিসেবে ছিলেন লেখক ও শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা  বলেন, প্রতিটি বিষয়ের পরিমার্জন এবং পরিবর্তনের জন্য আলাদা কমিটি কাজ করেছে। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে এটা আমার একার সিদ্ধান্ত নয়। আবার এজন্য শিশুদের দেশত্ববোধ কিংবা আত্মপরিচয়ে কোনো প্রভাব পড়বে না।

পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে রাখাল রাহা বলেন, বাচ্চারা শুরুতেই পড়া-লেখার বিষয় বুঝবে না। বরং তারা যদি একটা সুন্দর ছবি দেখতে পায় তাহলে তাদের মনস্তত্বে ইতিবাচক পরিবর্তনেআসতে পারে। আগামী শিক্ষাবর্ষের বইয়ে পরিমার্জনের ক্ষেত্রে বাচ্চাদের মনস্তত্বের দিকে নজর দেয়া হয়েছে।জানা গেছে, বড় পরিবর্তন না হওয়ায় প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ১৬ লক্ষ বইয়ের অন্তত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বই ছাপানোর কাজ শেষে ইতোমধ্যে বিতরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে চলে গেছে। বাকি থাকা বইগুলো ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রস্তত হবে বলে এনসিটিবির একাধিক  নিশ্চিত করেছেন। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে যে-রকম পরিবর্তন হয়েছে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ছবি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একইরকম থাকবে।

উৎপাদন ও বিতরণের সাথে সংশ্লিষ্ট এনসিটিবির এক কর্মকর্তা জানান, আমরা ইতোপূর্বে কখনো এমন পরিবর্তন দেখিনি। বিষয়টি জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের সম্মানের সাথে সাংঘর্ষিক। বইয়ের শুরুতে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ছবি থাকলে শিশুরা শুরুতেই দেশপ্রেম ও দেশত্ববোধের দীক্ষা পেত। কিন্তু এখন সেটা হবে না।

হাতে আসা প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির আমার বাংলা বই ঘেটে দেখা গেছে, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ছবি প্রতিটি বইয়ের শেষে দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় জাতীয় ফুল শাপলা ও গ্রাম বাংলার ইলাস্ট্রেশন রয়েছে। এছাড়া তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় সম্পাদনা পর্ষদের তথ্য প্রসঙ্গ কথা ও সূচিপত্রের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। এছাড়া সপ্তম পৃষ্ঠা থেকে বইয়ের মূল পাঠ শুরু। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বইকে এভাবেই সাজানো হয়েছে।

তবে বিগত বছরের বাংলা বই ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের পরেই জাতীয় পতাকা নির্মাণের তথ্যসহ ছবি এবং পরের পৃষ্ঠায় জাতীয় সংগীত এবং গাওয়ার জন্য জাতীয় সংগীতের পূর্ণ পাঠ স্থান পায়। বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রিন্ট মালিকরাও।

কয়েক দশক থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই ছাপানোর কাজ করেন এমন একজন প্রিন্ট মালিক বলেন, এমন পরিবর্তনের কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা জানা নেই। আমার মনে হয়, যারা এনসিটিবির সাথে সম্পৃক্ত তাদের যথাযথ জ্ঞানের অভাব ও দেশত্ববোধের অভাব রয়েছে। ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশের কথিা চিন্তা না করে তারা মনগড়া কাজ করেছেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফসের এ. এফ. এম সারোয়ার জাহানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক যে সমন্বয় কমিটি রয়েছে তারাই সকল ধরনের পরিবর্তন ও পরিমার্জনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেখানে কথা বলেন।’

পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, এটা টেকনিক্যাল বিষয়। তবে পরিবর্তন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে পারবেন সমন্বয়ক কমিটির সদস্য রাখাল রাহা।

বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করেছেন একাধিক প্রবীণ শিক্ষাবিদ। বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দ্যা ডেইলি ক্যম্পাসকে বলেন, এমন পরিবর্তন সরকারের লোকদের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে আমাদের জাতীয় স্বার্থের দিকে তাকালে বইয়ের শুরুতেই জাতীয় সংগীত ও পতাকার ছবি স্থান পেত। এর সাথে শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধ ও কর্তব্যবোধের বিষয় আছে। জাতীয় পতাকার ছবি ও জাতীয় সংগীত শুরুতে থাকলে তাদের ভাবনায় আসত এগুলোকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে হবে।

 

সূত্র:  দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *