Home » ডিমের দামে কেন এত হেরফের

ডিমের দামে কেন এত হেরফের

শরীরের প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা মেটাতে ডিমকে অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ ডিমের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের বাজারে ডিমের দাম নিয়ে চলছে আলোচনার ঝড়। সম্প্রতি ডিমের দাম বাজারে ১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এতে সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটি। সাধারণ মানুষ বলছে, ডিমের এই দাম আগে কখনও দেখেননি তারা।

এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আকাশচুম্বী এই দাম নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে তারা। একই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান শুরু করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরও।

ডিমের দাম কমাতে ভারত থেকে ডিম আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ৮ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্ত বাজারে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। ‘সাপ্লাই কম’, ‘মুরগির খাদ্যের দাম বেশি’— এমন নানা অজুহাতে উচ্চ দামেই বাজারে ডিম বিক্রি চলতে থাকে। একপর্যায়ে উৎপাদক থেকে ডিম বিক্রি কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ জানান পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতারা।

গত মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) ডিমের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। সে সময় তিনি জানান, পরীক্ষামূলকভাবে আগামী দুই সপ্তাহ ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি তেজগাঁও ও কাপ্তান বাজারে ডিলারদের কাছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত সরকার নির্ধারিত (উৎপাদক পর্যায়ে ১০.৫৮ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ১১.০১ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ১১.৮৭ টাকা) উৎপাদক পর্যায় থেকে পাইকারি পর্যায়ের যৌক্তিক মূল্যে ডিম সরবরাহ করবে।’

এ ক্ষেত্রে তাদের নির্ধারিত মূল্য হিসাব করলে দেখা যায়, উৎপাদক পর্যায় থেকে প্রতি পিস ডিম ১০.৫৮ টাকা করে বিক্রি করলে প্রতি ডজন ডিমের দাম পড়ে ১২৬.৯৬ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে থেকে প্রতি পিস ডিম ১১.০১ টাকা করে বিক্রি করলে প্রতি ডজন ডিমের দাম পড়ে ১৩৩.২ টাকা। আর খুচরা পর্যায়ে থেকে প্রতি পিস ডিম ১১.৮৭ টাকা করে বিক্রি করলে প্রতি ডজন ডিমের দাম পড়ে ১৪২.৪৪ টাকা।

কিন্তু জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের নির্ধারিত এই দামের তোয়াক্কা না করে শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) মিরপুর ১ নম্বরের কাঁচাবাজারে বেশি দামে বিক্রি হয় ডিম। একই সঙ্গে মিরপুর ২ নম্বর এলাকার বিভিন্ন মুদি দোকানেও অতিরিক্ত দামে বিক্রি হয় ফার্মের মুরগির ডিম। তাদের বিক্রি করা মুরগির ডিমের দামের মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র্য। একটি দাম নির্ধারণ করা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দামে। সরেজমিনে এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায় এই চিত্র।

মিরপুর ২ নম্বরের ২০টির বেশি মুদি দোকান ঘুরে দেখা যায়, তারা মুরগির প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি করছেন ১৫৫ থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত। তাদের মধ্যে জিদান জেনারেল স্টোরে প্রতি ডজন লাল ডিম ১৭০ টাকা করে বিক্রি করছিলেন।

এই দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, আমরা বাজার থেকে ডিম আনি না। আমাদের দোকানে এনে ডিম দিয়ে যায়। আজ ১৬৫ টাকা করে আমার কেনা পড়েছে। তাই আমি ১৭০ টাকা করে বিক্রি করছি।

অতিরিক্ত দামে ডিম বিক্রি করা নিয়ে এই এলাকার বেশির ভাগ বিক্রেতা একই সুরে কথা বলেন। তারা বলেন, আমাদের যে দামে কেনা হয়, তার থেকে কিছুটা লাভ রেখে আমরা বিক্রি করি। আমাদের ইচ্ছামতো বেশি দাম রাখার কোনও সুযোগ নেই।

এই মহল্লার অন্যান্য দোকান থেকে তুলনামূলক কম দামে মুরগির লাল ডিম বিক্রি করছিলেন মোল্লা জেনারেল স্টোর। তারা প্রতি ডজন ডিম বিক্রি করছিলেন ১৫৫ টাকায়। এই দোকানের বিক্রেতা মো. জনি বলেন, আমি আজ ১৫৫ টাকা করে বিক্রি করতে পারবো। আমার কেনা পড়েছে ১৫২ টাকা।

এ সময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার প্রতিদিন ৬০০ পিস ডিম লাগে গড়ে। কিন্তু গত সপ্তাহে সে পরিমাণ ডিম পাইনি, ৩০০ পিস করে ডিম পেয়েছি। আর গতকাল ডিম পাইনি। আজ যদিও ঠিকঠাক পেয়েছি।

এদিকে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গিয়েছিল বলে জানান নোয়াখালী জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা মিলন। তিনি বলেন, ডিমের দাম বাড়ায় বিক্রি অনেক কমে গিয়েছিল। আগে যারা দুই ডজন করে ডিম কিনতেন, তারা এখন কিনছেন এক ডজন। আর যারা এক ডজন করে কিনতেন, তারা ৬ থেকে ৮টা করে কিনছেন।

মিরপুর ১ নম্বরের কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা যায় ডিমের আরেক রকম দাম। তবে এই বাজারের বেশির ভাগ খুচরা বিক্রেতা নির্ধারিত দামের কাছাকাছিই বিক্রি করছেন। এর মধ্যেও কয়েক দোকানি বিক্রি করছিলেন বেশি দামে। আজ এই বাজারের খুচরা বিক্রির দোকানগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, তারা প্রতি ডজন মুরগির লাল ডিম বিক্রি করছেন ১৪৪ থেকে ১৫৫ টাকা এবং সাদা ডিম বিক্রি করছেন ১৩০ থেকে ১৪৪ টাকা দরে।

নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কেন বিক্রি করছেন, জানতে চাইলে বিক্রেতারা বলেন, আমরা নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে পারতাম কিন্তু আমরা আনার পর অনেক ডিম ভাঙা পাই। এ কারণে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করে সেই টাকা পুষিয়ে নিই।

এই বাজারের আব্দুল জব্বারের ডিমের দোকানে প্রতি ডজন লাল ডিম ১৫৫ টাকা করে বিক্রি করছিলেন। সবার থেকে কেন বেশি দামে বিক্রি করছেন, জানতে চাইলে তিনি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।

এই বাজারের পাইকারি দোকান রাজীব পুষ্টিবিতানে কথা হয়। তারাও নির্ধারিত দামের বেশি মূল্যে ডিম বিক্রি করছেন। কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, তাদের কেনা দাম বেশি পড়েছে। তাই বেশি দামে বিক্রি করছেন। এ সময় তারা ক্র‍য় রশিদও দেখান।

শুক্রবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বাজার পর্যবেক্ষণে আসে। সংস্থাটির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের দুই সহকারী পরিচালক রোজিনা সুলতানা ও ফারহানা ইসলাম অজন্তা এই অভিযান চালান। এ সময় তারা সবজি, ডিম, মাছ, মুরগির বাজার পর্যবেক্ষণ করেন।

অভিযান চালিয়ে তারা খুচরা ডিম বিক্রেতা আব্দুল জব্বারকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। ক্রয় রশিদ দেখাতে না পারায় তার এই জরিমানা করা হয়। আর পাইকারি বিক্রেতা রাজীব পুষ্টিবিতানকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। প্রতিষ্ঠানটি সরকার-নির্ধারিত মূল্যে ডিম কেনা জরিমানা দিতে হয়।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *