ভারতজুড়ে ছড়াচ্ছে জাল মোবাইল সিমবক্সে ব্যবসা। এর পিছনে রয়েছে জঙ্গিরা। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এই অবৈধ সিমবক্স থেকে বিদেশে যাওয়া ফোন কল ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। যার ফলে খুব সহজেই জঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারছে। এর নেপথ্যে মাস্টারমাইন্ড এক বাংলাদেশি। এমনটাই দাবি ভারতীয় পুলিশের।
ভুবেনশ্বরে টুইন সিটির পুলিশ কমিশনার সঞ্জীব পান্ডা জানিয়েছেন, এই ব্যবসার মূল পরিকল্পনাকারী একজন বাংলাদেশি নাগরিক আসাদুর জামান। জামান এই ব্যবসা চালানোর জন্য রাজু মণ্ডল নামে এক হ্যান্ডলারকে নিয়োগ করেছিল। তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সম্প্রতি ভুবনেশ্বরের কমিশনারেট পুলিশের একটি বিশেষ দল ভুবনেশ্বর ইউপিডির লক্ষ্মীসাগর থানা সীমানার মহাদেবনগরে একটি বাড়ি থেকে সাতটি সিম বক্স উদ্ধার করে। অভিযানের সময় পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক হাজারটি প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম কার্ড, পুরানো সিম কার্ড, রাউটার ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।
সঞ্জীব পান্ডা আরও বলেন, এই ঘটনার তদন্তে নেমে আমরা আন্তর্জাতিক লিংকসহ অবৈধ সিম কার্ড ব্যবসার একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছি। এর সঙ্গে আর কারা যুক্ত আছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে।
সিমবক্সের কাজ হলো অনেকটা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মতো। কিন্তু পুরোটাই বেআইনি। সাইবার প্রতারণার জগতে সিমবক্স জিনিসটি প্রতারকদের অন্যতম একটি অস্ত্র। এই বিশেষ যন্ত্রের কাজ হলো, বিদেশি কোনও নম্বরকে লোকাল নম্বরে পরিবর্তন করে দেওয়া। অর্থাৎ, বিষয়টি এমন যে আপনার মোবাইলে কোনও বিদেশি নম্বর থেকে ফোন আসছে। সাধারণভাবে সেখানে সংশ্লিষ্ট দেশের কোড দেখানোর কথা। কিন্তু সিমবক্স ব্যবহার করে বিদেশি নম্বর থেকে ফোন করা হলে, আপনি টেরই পাবেন না ওটি কোনও বিদেশি নম্বর। কারণ, আপনার মোবাইলের ডিসপ্লে-তে যে নম্বর দেখা যাবে, সেটি একটি দেশীয় নম্বর। ফলে মানুষকে বোকা বানিয়ে অনায়াসের নিজেদের কাজ হাসিল করে নিতে পারে প্রতারকদের দল। এটি এমন একটি ডিভাইস যা ৫০০টি পর্যন্ত সিম কার্ডের সঙ্গে ব্যবহার করা যেতে পারে।
স্ক্যামাররা স্থানীয় কল হিসেবে আন্তর্জাতিক কল করতে এটি ব্যবহার করে। অন্য কথায়, সিমবক্স একটি ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল) কলকে একটি জিএসএম কলে (মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তৈরি) রূপান্তর করে। আপনি যদি ভিওআইপি সম্পর্কে বিভ্রান্ত হন, এটি এমন একটি প্রযুক্তি যা ব্যবহারকারীদের নিয়মিত ফোন সংযোগের (জিএসএম) পরিবর্তে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভয়েস কল করতে সক্ষম করে। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ও টেলিকম পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য একটি ভিওআইপি কল ট্র্যাক করা বেশ সহজ। একটি সিম বক্সের মাধ্যমে যে কলগুলো করা হয় তা সনাক্ত করা বেশ কঠিন। কারণ একটি সিম বক্সে তিনটি ভিন্ন নোড থাকে এবং প্রতিটি নোড ডিজিটালি মাস্ক করা হয়। যা কলের উৎস ট্র্যাক করা কঠিন করে দেয়। একটি সিম বক্সের মাধ্যমে করা কল এবং এসএমএস জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো খুঁজে পায় না। এর মানে হলো হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের সহজেই লক্ষ্যবস্তু করা যেতে পারে এবং তাদের ডিভাইসের ডেটা নষ্ট করা যেতে পারে। একটি দেশের গোপন বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করে সাইবার অপরাধীদের কাছে বিক্রি করাও যেতে পারে।
পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত রাজু মন্ডল পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা এবং সে ভুবনেশ্বরে একটি ভাড়া বাসায় সিমবক্স চালাত। তার কাজ ছিল ইউপিএস, ইন্টারনেট, পাওয়ার এবং অন্যান্য পরিষেবাগুলো ঠিক কাজ করছে কি-না তা রক্ষনাবেক্ষন করা। তার কাছে থাকা সিমবক্সটি দিয়ে পাকিস্তান, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক কল বাইপাস করার জন্য ব্যবহার করছিল। এই ব্যবসার মূল হোতা একজন বাংলাদেশি নাগরিক আসাদুর জামান। জামান অক্টোবরে আগরতলা ও ভুবনেশ্বর হয়ে ভারত সফর করেন। ডিসেম্বরে তিনি বাংলাদেশে ফিরে যায়। অভিযুক্তরা বাসে করে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত যাতায়াত করত। সীমান্ত পার হওয়ার পর রাজু বাংলাদেশের টাঙ্গাইল গিয়েছিল। জামান ভারতীয় ভিসায় এদেশে এসে ভুবনেশ্বর ও কটকে সিমবক্স স্থাপন করে। সে হাওয়ালার মাধ্যমে রাজু কাছে টাকা স্থানান্তর করতেন।
সঞ্জীব পান্ডা এ বিষয়ে বলেন, ‘তদন্তে জানা গেছে, সিমবক্সগুলো গোপনে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করা হয়েছিল। এই কাজ করার জন্য জামান নিয়মিত অর্থ দিতো রাজুকে। সিমবক্সটি মূলত সাইবার অপরাধ, বিদ্বেষমূলক বার্তা, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য অপরাধে ব্যবহৃত হয়। কারণ এখানে আসল নম্বরগুলো আড়াল হয়ে যায়। যা খুঁজতে পুলিশের সমস্যা হয়।’
এই আন্তর্জাতিক অপরাধ নেটওর্য়াক সমন্ধে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হচ্ছে ওড়িশা পুলিশ, এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।
এর আগেও ২০২৩ সালে ১১ আগস্ট হাওড়ার মালিপাঁচঘড়া থানা এলাকায় একটি মামলা হয়েছিল। টেলিগ্রাফ আইন, ওয়ারলেস টেলিগ্রাফি আইনসহ বিভিন্ন ধারায় মামলা হয়েছিল। সেই মামলার তদন্তভার যায় এসটিএফ-এর হাতে। এক বাংলাদেশিসহ মোট সাত জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। ওই ঘটনার তদন্তে নেমে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের স্বরূপনগরে সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্ধার হয়েছিল সিমবক্সের সেট। এক বিশেষ অভিযানে রাজ্যের স্পেশাল টাক্স ফোর্স উদ্ধার করেছিল ১৩টি সিমবক্স মেশিন। এছাড়া প্রায় ৬০০টি বেনামি সিম কার্ড ও বেশ কিছু ইন্টারনেট রাউটারও বাজেয়াপ্ত করেন এসটিএফ-এর গোয়েন্দারা। ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল কবির দফাদার নামে বছর ৪৭-এর এক ব্যক্তিকে। গ্রেফতারকৃতের বাড়ি স্বরূপনগর থানা এলাকার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী দহরকন্দা গ্রামে।
গোয়েন্দাদের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গ থেকে এখন এই জাল সিমবক্সের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে অন্য রাজ্যগুলোতে।