ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানকে হারালেও টেস্টে পারছিল না বাংলাদেশ। ২০০১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে লাল বলের ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচ খেলেছিল। তার পর দেশে ও বাইরে দুই দল মুখোমুখি হয়েছে ১৩ বার। তার মধ্যে ১২টিতেই হার বাংলাদেশের, অন্যটি ড্র। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২৩ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে ঐতিহাসিক টেস্ট জয় তুলে নিয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল।
সিরিজের প্রথম টেস্টের লক্ষ্যটা ছিল খুবই ছোট। সময়ের হিসেবেও বাকি ছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টা, উইকেটও হাতে ১০টি। এতসব রসদ নিয়ে বাংলাদেশকে করতে হবে মাত্র ৩০ রান। এই রানটা সহজেই তুলে নেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার সাদমান হোসেন ও জাকির হাসান।
ঐতিহাসিক জয়ের অপেক্ষায় থাকা ক্রিকেটাররা ড্রেসিংরুমের সামনেই বসে ছিলেন। জাকির চার মারতেই সবার আগে লাফিয়ে উঠেন তরুণ ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয়। ইনজুরিতে না পড়লে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে জাকিরের জায়গাতে তিনিই থাকতেন। এরপর সাকিব-শান্ত-মুশফিকরা দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়টি উদযাপন করেছেন। সাকিবতো দুই হাত উঁচিয়ে দেখান উচ্ছ্বাস। হবেই না কেন, ২৩ বছরের অপেক্ষার অবসান বলে কথা।
যদিও বাংলাদেশ ২০০৩ সালেই পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের সাক্ষী হতে পারতো। কিন্তু ইনজামামের দৃঢ়তায় ১ উইকেটে তারা টেস্টটি হেরে গেছে। ওই টেস্টের কেউই এখন আর খেলছেন না। যখন ওই টেস্ট হচ্ছিল, সাকিব-মুশফিকদের কারও অভিষেক হয়নি।
মুলতান টেস্টের মতো আরও অনেক হারের সঙ্গী বাংলাদেশ দল। এবার অবশ্য তাদের আর ভুল হয়নি। দেশের মানুষকেও আর অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। দারুণ ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং উপহার দিয়ে দলকে ঐতিহাসিক এক জয় এনে দিয়েছেন মুশফিক-সাকিব-মিরাজ-সাদমানরা।
সফরকারীরা চতুর্থ দিন শেষ বিকালেই জয়ের সুবাস পাচ্ছিল। ১১৭ রানের পিছিয়ে থেকে পাকিস্তান দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামে। শেষ বিকালে এক উইকেট হারিয়ে তারা চাপে পড়ে যায়। রবিবার সকালে নেমে বাংলাদেশের স্পিনারদের ঘূর্ণিজাদুতে একে একে ব্যাটাররা কোণঠাসা হয়ে পড়লে ইনিংস ব্যবধানে হারের শঙ্কাও জাগে। শেষ পর্যন্ত রিজওয়ানের দায়িত্বশীল ইনিংসে কোনওমতে সেটা এড়িয়ে বাংলাদেশেকে ৩০ রানের লক্ষ্য বেঁধে দিতে পারে স্বাগতিক দল। পাকিস্তানের হয়ে শফিক ৩৭ ও রিজওয়ান ৫১ রানের ইনিংস খেলেছেন।
রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের প্রথম দিনেই বৃষ্টির কারণে খেলা শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। টস জিতে অধিনায়ক শান্ত পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান। শুরুতে বাংলাদেশের পেসাররা পাকিস্তানকে কঠিন চাপেও ফেলেছিল। মাত্র ১৬ রানে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটারকে তারা তুলে নেন। এরপর কঠিন পরিস্থিতি থেকে দলকে টেনে তোলেন সৌদ শাকিল ও মোহাম্মদ রিজওয়ান। শাকিলতো ৬৫ বছরের রেকর্ডে ভাগ বসিয়ে সেঞ্চুরির (১৪১) দেখা পেয়েছেন। মাত্র ২০ ইনিংসে এক হাজার রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনি। শাকিলের পর পাকিস্তানের অভিজ্ঞ ব্যাটার রিজওয়ান সেঞ্চুরি তুলে খেলেছেন ১৭১ রানের ইনিংস। এই দুইজনের জোড়া সেঞ্চুরিতে পাকিস্তান ৬ উইকেটে ৪৪৮ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে।
বিপরীতে বাংলাদেশও দ্বিতীয় দিন শেষ বিকালে দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম ও জাকির হাসানের ব্যাটে দারুণ শুরু পায়। তবে তৃতীয় দিন সকালেই জাকিরকে (১২) ফিরিয়ে জুটি ভেঙে দেন নাসিম শাহ। নাজমুল হোসেন শান্তও (১৬) দ্রুত বিদায় নিলে বাংলাদেশ কিছুটা চাপে পড়ে। তৃতীয় উইকেটে মুমিনুল হক ও সাদমান মিলে ৯৪ রানের জুটিতে সেই চাপ কাটিয়ে উঠেন। দারুণ খেলতে থাকা সাবেক অধিনায়ক মুমিনুল ৫০ ছুঁয়ে আউট হয়েছেন। মুমিনুলের বিদায়ের পর সেঞ্চুরির দিকে এগুচ্ছিলেন সাদমান। কিন্তু সেঞ্চুরি থেকে ৭ রান দূরে থাকতে আউট হন তিনি। সাকিবও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। তার পর রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের মোড় ঘুরে যায় মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের বড় দুটি জুটিতে। তাদের দৃঢ়তা প্রথম ইনিংসের স্কোর ৫৬৫ রানে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখে।
লিটনের সাথে ১১৪ রানের জুটির পর মিরাজকে নিয়েও ১৯৬ রানের জুটি গড়েন মুশফিক। তবে দারুণ এই ইনিংস খেলেও নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন তিনি। ডাবল সেঞ্চুরি থেকে ৯ রান দূরে থাকতে আউট হন উইকেট কিপার ব্যাটার। ৩৪১ বলে ২২ চার ও ১ ছক্কায় ১৯১ রানের ইনিংস খেলে তিনি আউট হয়েছেন। মুশফিকের বিদায়ের পর মিরাজও ৭৭ রানের ইনিংস খেলে দলের স্কোরকে বড় করতে ভূমিকা রাখেন।
১১৭ রানে পিছিয়ে থেকে পাকিস্তান নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেও সাকিব-মিরাজের ঘূর্ণির সামনে দাঁড়াতেই পারেনি। দুইজন মিলে তুলে নিয়েছেন সাতটি উইকেট। বাকি তিনটি উইকেট পেসার শরিফুল, হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। ২১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার অফস্পিনার মিরাজের। এছাড়া ৪৪ রানে তিনটি উইকেট শিকার করেছেন সাকিব। এই তিন উইকেটে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন ড্যানিয়েল ভেট্টরিকে। টেস্ট ক্রিকেটে বাঁ হাতি স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক এখন তিনি।
বাংলাদেশের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪৬ রান সংগ্রহ করতে পারে পাকিস্তান। তাতে লিডও দাঁড়ায় মাত্র ২৯ রানের। ৩০ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে বাংলাদেশ সপ্তম ওভারেই বিনা উইকেটে জয় নিশ্চিত করে। জাকির হাসান ১৫ এবং সাদমান ইসলাম ৯ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন।