সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উলটপালট হচ্ছে পূর্বের সমিকরণ। দিনদিন পাল্টে যাচ্ছে হিসেব-নিকেশ। পাল্টে যাচ্ছে ভোটারদের ধারণাও। সাম্প্রতিক নানান ঘটনাপ্রবাহ মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে মাঠের। জাতীয় নির্বাচনে সিলেট-৫ উঠে আসছে আলোচনার কেন্দ্রে।
স্বতন্ত্রপ্রার্থী মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী আলিয়া ঘরনার আলেম। অথচ তাকেই অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসছেন কওমির আলেমরা। আবার তিনি সরকার দলের নৌকা প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বি! কিন্তু সেই দলের নেতাকর্মিরা তার হয়ে প্রচারণায় নেমেছেন। এসব দৃশ্যই মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে সিলেটের জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলা নিয়ে সিলেট ৫ সংসদীয় আসনের। আর এটিই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নৌকার প্রার্থী মাসুক উদ্দিন আহমদ ও স্বতন্ত্রপ্রার্থী ড. আহমদ আল কবিরের।
এ আসনে মোট ৭ প্রার্থী। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের মাসুক উদ্দিন আহমদ (নৌকা), বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহের সভাপতি, স্বতন্ত্রপ্রার্থী মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী (কেটলি) এবং স্বতন্ত্রপ্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা, সীমান্তিকের প্রতিষ্ঠাতা ড. আহমদ আল কবির (ট্রাক)। তিনজনই নির্বাচনী মাঠে হেভিওয়েট প্রার্থী। আবার ৩ জনই জকিগঞ্জ উপজেলার! একারণে কানাইঘাটের চেয়ে নির্বাচনী উত্তাপ বেশি জকিগঞ্জ উপজেলায়!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ায় শুরুর দিকে মাসুক উদ্দিন আহমদ বেশ আলোচনায় ছিলেন। তিনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেও তিনি জকিগঞ্জে এসে যেন খেই হারিয়ে ফেলেছেন। এখানকার আওয়ামী লীগ তিন ভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তির ফলে তার পক্ষে নৌকা মার্কার সুবিধা ভোগ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিরোধীপক্ষ ছাড়াও গত কয়েকদিন ধরে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের নেতা-কর্মি প্রকাশ্যে তার বিরোধী পক্ষের হয়ে প্রচারণায় নেমেছেন। সেখানে তার ঘনিষ্ঠজনেরাও রয়েছেন। এমনকি নিকটত্মীয়দেরও দেখা যাচ্ছে তার প্রতিপক্ষের হয়ে প্রচারণায় করতে।
সূত্র জানায়, স্থানীয়ভাবে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে হয়রানির অভিযোগ, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ভোটারদের মাঝে নেতিবাচক ইমিজ তৈরি করেছে। তবে একজন প্রবীণ রাজনীতিক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি এখনও একটি বিরাট অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য।
অপর হেভিয়েট প্রার্থী ড. আহমদ আল কবির আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্থানীয়ভাবে তারও একটি গ্রুপ রয়েছে। তার নিজের বলয়ের বিশাল একটি অংশ মাঠে নেমেছে তার হয়ে। নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পাচ্ছেন নিজের এনজিও সীমান্তিকের কর্মীদের। সীমান্তিকের মতো বৃহৎ একটি এনজিওর সর্বস্তরের কর্মীরা বাধ্যতামূলক তার পক্ষে কাজ করায় তিনি বিশাল এক কর্মী বাহিনি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তবে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে এনজিওর প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকায় তাকেও বেকায়দায় ফেলতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। বিশেষত এনজিওর নারী কর্মীদের দিয়ে প্রচারণা অনেক ভোটারই সুনজরে দেখছেন না, যেখানে এই অঞ্চলের সব ঘরানার আলিমদের মধ্যেই রয়েছে এনজিও বিরোধী আন্দোলন করে জেল-জুলুমের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা। জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আব্দুল আহাদসহ জকিগঞ্জ আওয়ামীলীগের একাংশের সমর্থন তিনি পাচ্ছেন প্রকাশ্যে। অন্যদিকে ড. কবির এক সময়ের হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং তার ‘নির্বাচনী এজেন্ট’ হওয়ার সুবাদে বিএনপির একাংশও গোপনে তাকে সহযোগিতা করছে। সেখান থেকেও কিছু ভোট তার ঝুড়িতে এসে জমা হবে।
তবে সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী। বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় পরিবারের সন্তান তিনি। বৃহত্তর সিলেটের প্রতিটি আসনেই তার অনুসারীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট থাকায় সব সময়ই নির্বাচনী রাজনীতিতে তিনি গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। ইতিপূর্বে আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ এমপি মন্ত্রীরা প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন যে তাকে প্রধানমন্ত্রী এমপি পদে মনোনয়ন দিতে চাইলেও তিনি মনোনয়ন গ্রহণ করতে রাজি হন নি। এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ তাই অনেকটা চমকের সৃষ্টি করেছে এ আসনে। তার অনুসারীদের মূল ভোট ব্যাংক জকিগঞ্জ উপজেলায়। কানাইঘাটের তার অবস্থান কিছুটা দুর্বল হলেও পাঠ্যপুস্তক সংশোধনসহ বিভিন্ন ইসলামি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের ফলে জকিগঞ্জ-কানাইঘাট সহ দেশের সর্বস্তরের মানুষের নিকট তার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কওমি ধারার আলেম না হলেও এবারের নির্বাচনে কওমি ধারার উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ আলেমগণ তার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কানাইঘাট উপজেলায় তাদের প্রভাব তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া তার বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আব্দুল লতীফ চৌধুরী ফুলতলীর (রহ) এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও তার জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। মূলত অল্লামা ফুলতলী (রহ.)র গ্রহণযোগ্যতার কারণে দলমত নির্বিশেষে সমর্থন পাচ্ছেন তিনি। এমনকি এই আসনের উভয় উপজেলার ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের মূল অংশ প্রকাশ্যে তার পক্ষে গণসংযোগ করছে। একাধিক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও প্রকাশ্যে তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে নানা জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত নৌকার পক্ষে থাকেন। তবে এবারের আওয়ামীলীগ প্রার্থী তাদেরকে কাছে টানতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই ভোট ব্যাংকও এবার বিভক্ত। মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ইসলামি ব্যক্তিত্ব হলেও তার পরিবারের সামাজিক সহায়তামূলক কার্যক্রমের কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ভোট রয়েছে তার। এলাকার হিন্দু ভোটাররা বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় প্রকাশ্যে তার পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন এবং গণসংযোগেও অংশগ্রহণ করছেন। তবে মাসুক উদ্দিন আহমদ এবং ড. আহমদ আল কবিরও এই ভোট ব্যাংকে কিছুটা ভাগ বসাতে পারেন।
এই আসন ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় এই আসন থেকে আলিম-উলামা নির্বাচিত হয়েছেন। এমনকি ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচেনে বড় সব দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও মাওলানা ওবায়দুল হক উজিরপুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাছাড়া পাকিস্তান আমলে এই আসন থেকে এমএলএ হয়েছিলেন শায়খুল হাদীস মুশাহিদ আহমদ বায়মপুরী, যিনি কওমি ঘরানার হলেও ফুলতলী পরিবারের সাথে তার হৃদ্যতা ও ঘনিষ্টতা ছিল। মূলত এখানকার ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুটি ধারা রয়েছে, ফুলতলী ও কওমি। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনের মতো উভয় ধারার আলিমগণের সমর্থন থাকলে এ আসন থেকে যে কোন আলেম সহজেই বিজয়ী হতে পারেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এবারের নির্বাচনে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী এ সুবিধা পাচ্ছেন বলে অনেকের ধারণা।
এই সংসদীয় আসনের ভোটাররা সব সময় সাধারণত ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেন। সিলেট-৫ আসনে যারাই নির্বাচিত হয়েছিলেন, সবাই রাজনৈতিক সহিংসতা বিরোধী এবং দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে দলমত নির্বিশেষে স্বীকৃত। সাবেক এমপিদের বিরুদ্ধে ভোটারদের বহু অভিযোগ থাকলেও কোন এমপির বিরুদ্ধেই দুর্নীতি কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতা ও হয়রানিতে মদদ দেয়ার অভিযোগ নেই। বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও এরকম অভিযোগ উঠেনি। স্থানীয় ভোটাররা এ বিষয়টি সব সময় প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
এসব বিবেচনায় এ আসনে বর্তমানে আলোচনার র্শীষে চলে এসেছেন মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী (কেটলি)। স্থানীয়রা মনে করছেন, তার সাথে প্রতিদ্বন্দিতায় থাকবেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. আহমদ আল কবির (ট্রাক)। মাসুক উদ্দিন আহমদ বিভক্ত আওয়ামী লীগ ও ব্যক্তি ইমেজের ঘাটতির কারণে হয়তো পিছিয়ে পড়বেন। এর বাইরে কানাইঘাটের কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভোট পেতে পারেন তৃণলমূল বিএনপি মনোনীত ব্যারিস্টার কুতুব উদ্দিন শিকদার। এ আসনের অন্যান্য প্রার্থীরা হচ্ছেন, জাতীয় পার্টির শাব্বীর আহমদ (লাঙ্গল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের বদরুল আলম (ডাব), মুসলিম লীগের (বিএমএল) খায়রুল ইসলাম (হাত-পাঞ্জা)। এখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ২ হাজার ৩২৫ জন। [সূত্রঃ শুভ প্রতিদিন]
প্রতিনিধি