একা গরমে রক্ষা নেই, লোডশেডিং দোসর! আবহাওয়া দফতরের এখনও পর্যন্ত যা পূর্বাভাস তাতে কলকাতায় গরম থাকবে। তাপপ্রবাহের কষ্টও সহ্য করতে হবে। ‘স্বস্তি’ দেওয়ার মতো বৃষ্টির কোনও লক্ষণ নেই। তার মধ্যেই লাগাতার বিদ্যুৎবিভ্রাট। সব মিলিয়ে একেবারে নাজেহাল দশা শহরবাসীর।
গত কয়েক দিনের পরিস্থিতি যদি দেখা যায়, কলকাতা-সহ শহরতলির যে সব এলাকায় সিইএসসির পরিষেবা রয়েছে, সেখানে দুর্ভোগের শেষ নেই। বেলঘরিয়া থেকে বালিগঞ্জ, বহুতলের বাসিন্দা থেকে বস্তিবাসী সকলেই লোডশেডিংয়ের দাপটে দুঃসহ অবস্থার অভিযোগ করছেন। যদিও এই পরিস্থিতিকে আদৌ ‘লোডশেডিং’ বলে মানতে রাজি নন সিইএসসি কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, সংস্থার কাছে বিদ্যুতের কোনও ঘাটতি নেই, যতটা চাহিদা তা পূরণ করার ক্ষমতাও রয়েছে। যত সমস্যা হচ্ছে ‘নিয়ম না মানা’ গ্রাহকদের জন্য। সব দোষ গ্রাহকদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার যুক্তি হিসাবে সিইএসসি কর্তারা বলছেন, দিন দিন বাতানুকুল যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু অনেকেই বাড়িতে এসি নিলেও তা নিয়ম মেনে জানাচ্ছেন না। এর ফলে কোনও এলাকায় বিদ্যুতের যে পরিমাণ ‘লোড’ ঠিক করা রয়েছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে ব্যবহার। আর তাতেই এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
সিইএসসির এগ্জ়িগিউটিভ ডিরেক্টর অভিজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘বিদ্যুতের কোনও ঘাটতি নেই। কিন্তু এত মানুষ আমাদের না জানিয়ে এসি লাগাচ্ছেন যে, সিইএসসির কাছে অনেক এলাকার লোড সম্পর্কে আগাম ধারণা নেই। সেই কারণেই সমস্যা হচ্ছে। আমরা সকলের কাছে আবেদন করছি, নিয়ম মেনে আমাদের জানিয়ে এসি লাগান ও ব্যবহার করুন।’’ একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে ৪৫ হাজারের মতো এসি লাগানোর আবেদন জমা পড়েছে। আর এই সময়ে এসি বিক্রি হয়েছে দেড় লক্ষের উপরে।
সিইএসসি-র বক্তব্য, এটা ‘লোডশেডিং’ নয়, ‘ফিউজ়িং’। অর্থাৎ, যখনই নির্ধারিত লোডের বেশি ব্যবহার হয়ে যাবে তখন আপনাআপনি ‘ফিউজ় ট্রিপ’ হয়ে যাবে। ফলে এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ‘লোড’ সামলাতে না পারায় এলাকা আঁধারে ডুবে যাওয়াকে অবশ্য সাধারণ মানুষ ‘লোডশেডিং’ই বলে। সিইএসসি যে নামই দিক না কেন, বিষয়টা আসলে ‘কষ্ট’। আর সে ‘কষ্ট’ যে চলতেই থাকবে তা মুখে না বললেও কথায়বার্তায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন সিইএসসি কর্তারা।
কেমন কষ্ট হচ্ছে সাধারণের? বাগুইআটির বাসিন্দা অভীক সমাদ্দারের বক্তব্য, ‘‘দিনের পর দিন একই জিনিস চলছে। রাত ১১-১২টা নাগাদ পাওয়ার কাট। আসছে ভোরের দিকে। সারাদিন পরিশ্রম করে হা ক্লান্ত হয়ে আসা ঘুমের প্রত্যাশী মানুষ দরদর করে ঘামবে। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আর যাঁরা ইতিমধ্যেই অসুস্থ, তাঁরা আরও অসময়ের প্রহর গুণবেন। এই অনুভূতি আমার একার নয়। ফেসবুকে রোজ রাত্রে হাজার হাজার মানুষ এমন কথা লিখছেন।’’ একই সুর গরফার এক অভিজাত আবাসনের বাসিন্দা শ্রীময়ী সান্যালের। তিনি বলেন, ‘‘পয়সা তো আমরা কম দিই না। যা বিল আসে তাই সময়ে মেটাতে হয়। কোনও যাচাই করার পদ্ধতিও নেই। তা সত্ত্বেও প্রতি দিন এমন কষ্ট কেন সইতে হবে? একে এত গরম, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আমার সন্তানের বয়স মাত্র তিন বছর। প্রতিদিন রাতে তার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।’’
শুধু কলকাতা নয়, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার অনেক এলাকাতেই সিইএসসি পরিষেবা রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের অভিযোগও একই রকম। হাওড়া রামরাজাতলার বাসিন্দা অশীতিপর সৌরদীপ সামন্ত বলেন, ‘‘গরম যে ভাবে বাড়ছে তাতে এসি তো চালাতেই হবে। আর পয়সা যখন নিচ্ছে তখন পরিষেবাও দিতে হবে। আমাদের দিকে আঙুল তুললেই তো আর হবে না।’’
এমন সব বক্তব্য যে সিইএসসি কর্তৃপক্ষের অজানা, তা নয়। কিন্তু তাঁদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। অভিজিৎ বলেন, ‘‘না জানিয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য ওভারলোডিং হচ্ছে। এর ফলে ফিউজ়িং ব্যবস্থা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ওভারলোডের ফলে বড় দুর্ঘটনা যাতে না হয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা।’’ কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা তো দিন দিন বাড়তেই থাকবে! আরও বেশি মানুষ এসি ব্যবহার করবেন। তা হলে এর কি কোনও সমাধান নেই? সিইএসসি কি বেশি লোড নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না? এমন প্রশ্নও উঠছে। অভিজিৎ বলেন, ‘‘কেউ যদি একটা বাল্ব বা ফ্যান লাগান তবে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু এসি লাগালেই ওভারলোডের সম্ভাবনা বেশি।’’ কিন্তু বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে অভিযোগ জানালেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনেক সময় লাগার অভিযোগ উঠছে কেন? অভিজিৎ বলেন, ‘‘প্রযুক্তিগত যে ব্যবস্থা রয়েছে তাতে লোড না কমা পর্যন্ত বিদ্যুৎ আসবে না। সব ঠিক হওয়ার পরে ফের ওভারলোড হলে আবারও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হবে। এটাই প্রযুক্তি।’’
সিইএসসি কর্তা নিজে মুখে স্বীকার না করলেও আসলে বিষয়টা এমনই দাঁড়াচ্ছে যে, আশু সমাধান কিছু নেই। প্রযুক্তিগত ভাবেই গরমে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হতে থাকবে কলকাতা শহর ও শহরতলি। এসি নিয়ে এই অভিযোগ নতুন নয়। আর তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বালির বাসিন্দা অমিত সরকার। তিনি বলেন, ‘‘সবাই তো আর এসি ব্যবহার করেন না। আমাদের বাড়িতে তো ফ্যানই ভরসা। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকার কারণে আমরা কেন কষ্ট পাব? যাঁরা না জানিয়ে এসি লাগাচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না সিইএসসি?’’ এই প্রশ্ন করা হলে অভিজিৎ বলেন, ‘‘আমরা গ্রাহকদের বিনম্র ভাবেই বলি যে, আমাদের জানান। কিন্তু অনেকেই তা শোনেন না। এই ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও সেটা সাধারণত করা হয় না। তবে অনেককেই নোটিস পাঠানো হয়েছে। কেউ কেউ আবার একটি এসির অনুমতি নিয়ে একাধিক লাগাচ্ছেন।’’ কিন্তু কেন গ্রাহকরা জানান না? খরচের ভয়ে? এমন প্রশ্ন করা হলে অভিজিৎ বলেন, ‘‘সব সময় যে খরচ হবে তার কোনও মানে নেই। যদি দেখা যায় কোনও গ্রাহকের যে মিটার রয়েছে তাতে এসি লাগানো যাবে সে ক্ষেত্রে তো কোনও খরচই নেই।’’ কিন্তু সেটা না হলে কত খরচ? এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে সিইএসসি কর্তার বক্তব্য, ‘‘খুব বেশি নয়। একটা এসির যা দাম তার থেকে অনেক অনেক কম খরচ। এর পরে কতটা লোড দেওয়া হবে সেই হিসাবে বিভিন্ন স্তর রয়েছে খরচের।’’
ইংরেজি মাধ্যমেও পড়ানো চলছে সরকারি স্কুলে, বাড়ছে পড়ুয়া
চলতি বছরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে বলেও জানিয়েছে সিইএসসি। ২০২২ সালে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সরবরাহ ছিল মে মাসের একটি দিনে। সরবরাহ করা হয়েছিল ২,৩৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর চলতি বছরে সর্বোচ্চ সরবরাহ হয় গত ১৮ এপ্রিল ২,৫০৩ মেগাওয়াট। চাহিদা বেড়েছে, তাই সরবরাহও বেড়েছে বলে দাবি করছে সিইএসসি। একই সঙ্গে সংস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভও বেড়েছে। এখন যা খুবই বেশি।
হুগলির কোন্নগরের বাসিন্দা উৎপল রায় বলেন, ‘‘আসলে সিইএসসির একচেটিয়া ব্যবসা হওয়াতেই সব সমস্যা। প্রতিযোগিতা নেই বলে যা খুশি করে। আর আমাদের অন্যত্র যাওয়ার উপায় নেই বলে সব মেনে নিতে হয়। দিন দিন খরচ বাড়ছে, ভোগান্তিও বাড়ছে। এত গরম যে ফ্যান চালিয়ে শুলেও বিছানা ঘামে ভিজে যাচ্ছে। ও দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারেন্ট নেই।’’ সিইএসসির পক্ষে অবশ্য ‘একচেটিয়া’ ব্যবসার অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিজিৎ বলেন, ‘‘শুধু আমরা নই, সব ক্ষেত্রেই একই নিয়ম। অন্য রাজ্য তো বটেই, বাংলাতেও রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের ক্ষেত্রেও এসি নেওয়ার জন্য একই নিয়ম।’’
তবে শুধু সিইএসসি এলাকাতেই নয়, গোটা রাজ্যেই বিদ্যুৎবিভ্রাট সমস্যায় ফেলেছে মানুষকে। অভিযোগ রয়েছে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের বিরুদ্ধেও। তবে সম্প্রতি বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও একই কথা বলেছেন। তিনিও জানিয়েছেন, উপভোক্তারা নির্দিষ্ট পরিমাণের থেকে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করার ফলেই বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে। এর জন্য কন্ট্রোল রুমও চালু করেছে বিদ্যুৎ দফতর।
নির্বাহী সম্পাদক