সিলেটের ‘পাথর রাজ্যের’ শ্রমিকদের অভাব-অনটনে দিন কাটছে। একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৪-৫শ টাকার মতো রোজগার করলেও সংসারে খরচ করতে হয় ৬-৭শ টাকা। কোনো কোনো সময় একটু বেশি আয় হলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়।
জেলার কোম্পানিগঞ্জে ধলাই নদীর কোয়ারিগুলো বন্ধ থাকায় রোজগারের পথ আরও সংকুচিত হয়েছে বলে দাবি ওই অঞ্চলের পাথর শ্রমিকদের। শ্রমিকরা চান, অবৈধ বোমা মেশিন না চালানোর শর্তে ওই নদীর কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়া হোক।
পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে ২০১৯ সালে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করেছে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া জাফলং, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি, লোভছড়া কোয়ারি থেকেও পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়।
একজন পাথর শ্রমিক বলেন, ১০ সদস্যের সংসার চালাতে পারছেন না; কারণ আগের মতো রোজগার নেই। কোনো দিন ৬০০, কোনো দিন ৪০০ টাকা উপার্জন হয় তার। মে দিবসের বিষয়ে জানতে চাইলে তার ভাষ্য, তাদের কোনো মে দিবস নেই। পেটের মে-ই বড় ‘মে’।
“আমরা কাজ করলে ভাত খাই। তাই প্রতিদিনই পেটের দিবস।”
সংসার খরচের পাশাপাশি আছে সুদের বোঝা আর এনজিওর কিস্তি।
আরেক শ্রমিক ভুবন বিশ্বাস বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অভাব-অনটনে সংসার চলছে। মাঝে-মধ্যে ধার দেনাও করে চলতে হচ্ছে। তার পরিবারে সাতজন সদস্য রয়েছে। কাজ থাকলে খাবার জুটে, না থাকলে দু’বেলা খাবারও জুটে না। তিনি জানান, আগের মতো কাজ নেই। অনেক দিন ধরে কাজ কমে গেছে। এখন কোনো দিন ৬০০, আবার কোনো দিন ৭০০ টাকা উপার্জন করতে পারেন হ্যামার দিয়ে বড় পাথার ভেঙে। তবে মাঝে-মধ্যে কাজ বন্ধও থাকে।
মে দিবসের বিষয়ে তার ভাষ্য, “আমরা এত দিবস-টিবস বুঝি না। কাজ কইরা খাই। নদীটা (পাথর কোয়ারি) খুলা তাকলে দিনে রাইতে কাজ করতে পারতাম; তকন আয়-রোজগারও বেশি হইত। আমারার কতা শুনব কে? কেউ শুনে না।”
৬০ বছর বয়সী নারী শ্রমিক প্রণতি রাণী বিশ্বাস। বালু থেকে চিপ (ছোট আকৃতির) পাথর সংগ্রহ করছিলেন।জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারখানায় পাথর ভাঙার কাজ করেন একযুগ ধরে। কিন্তু নদীর কোয়ারিগুলো বন্ধ হওয়ার পর থেকে বালু থেকে চিপ পাথর কুড়ান এখন। কোনো দিন ১০০ টাকা, কোনো দিন ৮০ বা ৬০ টাকা রোজগার হয় কুড়ানো চিপ পাথর বিক্রি করে। ছেলেও কাজ করে; তবুও অভাব তাদের সংসারের পিছু ছাড়ছে না।
৭০ ঊর্ধ্ব আরেক নারী রমিজা বেগম জানান, বয়সের কারণে বেশি কাজ করতে পারছেন না। সংসারের অভাব থাকায় বালু থেকে চিপ পাথর কুড়িয়ে বিক্রি করে যতসামান্য আয় করেন তিনি।
নারী-পুরুষের পাশাপাশি পাথর ভাঙার কাজে আছে কিশোর-কিশোরীরাও। ১৪ বছরের কিশোর আবু সাহিদ ও ১৭ বছর বয়সী তার বড় ভাই রাসেল। সংসারে বাবাকে সহযোগিতা করতে গিয়ে তারাও পাথর ভাঙার কাজ করছে। তারা জানায়, আগে দুজনই মাদ্রাসায় পড়ত। সাত সদস্যের পরিবারে একা বাবার পক্ষে সংসার চালানো কঠিন। তাই দুই ভাই মিলে বালু থেকে চিপ পাথর কুড়িয়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা রোজগার করে তারা।
ভাই ভাই ক্রাশার মিলের পরিচালক মো. লায়েক হাসান জানান, প্রতিদিন তাদের এখানে ২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে ১০ জনই নারী শ্রমিক। আমদানি করা পাথর দিয়ে ব্যবসা করে লোকসানে আছেন বলে জানান তিনি।
সোহান স্টোন ক্রাশারের মেশিন চালক মো. হেলাল জানান, তাদের এখানে প্রতিদিন ১০ জন নারী কাজ করেন।
কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক ফখর উদ্দিন জানান, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সারা দেশে পাথর রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এখান থেকে এক সময় প্রতিদিন হাজার-হাজার ট্রাক পাথর সরবরাহ করা হতো সারাদেশে। দিনে-রাতে পাথরের মিলগুলো চলত। তবে নদী থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় এখন ভারত থেকে এলসি করা পাথর দিয়ে বড় ব্যবসায়ীদের মিলগুলো চলছে। অনেক ছোট বা মাঝরি ব্যবসায়ীর ব্যবসায় বন্ধ রয়েছে।
নদী থেকে বালু-পাথর তোলা বন্ধ হওয়ার পর থেকে এলাকার শ্রমিকেরা অন্য কাজে যোগ দিয়েছেন। কেউ-কেউ আবার অন্য এলাকায় গিয়েছেন কাজের সন্ধান করছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বালু-পাথর উত্তোলন ও বহনকারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, “নদী বন্ধ হওয়ার আগে কোম্পানীগঞ্জে লাখ-লাখ শ্রমিক কাজ করতেন। আমাদের ট্রেড ইউনিয়নের ২০ হাজার সদস্য আছেন। বর্তমানে নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে জীবিকার তাগিদে এলাকা ছেড়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন। আমরা শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে দাবি জানাই, দ্রুত সনাতন পদ্ধতিতে বালু-পাথর উত্তোলের জন্য নদীটি খুলে দেওয়া হোক।”
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, “২০১৯ সাল থেকে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি খনিজ সম্পদ অধিদপ্তরের লোকজন কোয়ারিগুলো পরিদর্শন করে গেছেন। পাথর উত্তোলন সংক্রান্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালায়ে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা এখনও পাথর উত্তোলন সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন পাইনি।”
প্রতিনিধি