সিলেট অঞ্চলের ইতিহাসের কথা আমাদের অনেকেরই জানা আছে। ১৭৭২ সালে সিলেট জেলার জন্ম হয়ে পরবর্তীকালে শত বছর ছিল বাংলার অধীনে। ১৮৭৪ সালে আসাম প্রদেশের অধীনে সিলেট জেলা চলে যায়। বঙ্গভঙ্গের অল্প কয়েক বছর বাদে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা আসামের অধীনেই ছিল। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলার ছিল চারটি মহকুমা, যথা-শ্রীহট্ট সদর, করিমগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ। ১৮৮২ সালে শ্রীহট্ট সদর ভেঙে শ্রীহট্ট দক্ষিণ নামে আরেকটি মহকুমা তৈরি করা হয়। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের সময়ে করিমগঞ্জ আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় করিমগঞ্জ সদর থানা দুইভাগ হয়ে অর্ধেক এলাকা জকিগঞ্জ থানা নামে শ্রীহট্ট সদর মহকুমার আওতাভুক্ত হয়। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত করিমগঞ্জ মহকুমার অধীনে জলঢুপ ছিল একটি থানা। এ বছর থানাটি বিলুপ্ত হয়ে বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা থানা নামে দুটি থানা আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের সময় থানা দুটি করিমগঞ্জ মহকুমা থেকে আলাদা হয়ে বিয়ানীবাজার থানা শ্রীহট্ট সদরের অধীনে চলে আসে এবং বড়লেখা চলে যায় শ্রীহট্ট দক্ষিণ মহকুমার অধীনে। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর সিলেট জেলার অধীনে চারটি মহকুমা রয়ে যায়। শ্রীহট্ট সদর, শ্রীহট্ট দক্ষিণ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ। সিলেট জেলা সৃষ্টির পর হতে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল শ্রীহট্ট। ১৯৬০ সালে শ্রীহট্ট দক্ষিণ মহকুমার নাম পরিবর্তিত হয়ে মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহর নামানুসারে এ মহকুমার নাম হয় মৌলভীবাজার। ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার জেলায় উন্নীত হয়।
দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার থানা ছিল ছয়টি। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন থানা শ্রীমঙ্গল, যা ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মৌলভীবাজার সদর থানা, রাজনগর ও কুলাউড়া থানা তিনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯২২ সালে। বড়লেখা থানা সৃষ্টি হয় ১৯৪০ সালে। কমলগঞ্জ থানার সৃষ্টি ১৯৮৩ সালে।
জুড়ী এলাকার নামকরণ করা হয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বয়ে আসা ‘জুড়ী’ নদীর নামানুসারে। নদীটি বর্তমান জুড়ী থানা এলাকার মধ্য দিয়ে হাকালুকি হাওড় হয়ে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলেছে। নদীর দুপাশেই জুড়ী থানা এলাকার বিস্তৃতি। কুলাউড়া থানার অধীনে জুড়ী নামে একটি পুলিশ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৯ সালে ক্যাম্পটি তদন্ত কেন্দ্রে উন্নীত হয়।
যেহেতু কুলাউড়া থানার সতেরোটি ইউনিয়ন এবং বড়লেখা থানার বারোটি ইউনিয়ন ছিল। সুতরাং বড়ো দুটি থানার মাঝখানে অবস্থিত জুড়ী এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আলাদা একটি থানা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২৬ আগস্ট ২০০৪ সালে নিকার এর ৯০তম বৈঠকে বাংলাদেশের ৪৭১তম প্রাশাসনিক উপজেলা হিসেবে জুড়ী থানার আত্মপ্রকাশ ঘটে। থানা সৃষ্টির সময়ে এর ইউনিয়ন ধরা হয় আটটি। এর মধ্যে বড়লেখা থানার চারটি (যথা-পূর্বজুড়ী, পশ্চিমজুড়ী, দক্ষিণভাগ ও সুজানগর ইউনিয়ন) এবং কুলাউড়া থানার চারটি (যথা-জায়ফরনগর, গোয়ালবাড়ী, সাগরনাল ও ফুলতলা ইউনিয়ন)। পরবর্তীকালে মহামান্য হাইকোর্টে রিটের আলোকে বড়লেখা থানার দক্ষিণভাগ ও সুজানগর ইউনিয়ন বাদ পড়ে বাকি ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে বর্তমানে থানাটির কার্যক্রম চলছে। ইউনিয়নগুলো হলো-পূর্বজুড়ী, পশ্চিমজুড়ী, জায়ফরনগর, গোয়ালবাড়ী, সাগরনাল ও ফুলতলা। প্রতিটি ইউনিয়নকে একটি পুলিশ ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করে বিট হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে বিট পুলিশিং কার্যক্রম চলমান। উল্লেখ্য যে, পুলিশিং-কে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়াই বিট পুলিশিংয়ের মূল উদ্দেশ্য।
জুড়ী থানার উত্তরে বড়লেখা থানা, দক্ষিণে কুলাউড়া থানা, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যের সীমানা ও পশ্চিমে হাকালুকি হাওড়। থানা এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। এখানে রয়েছে এগারোটি চা বাগান, কমলা বাগান, খাসিয়া পল্লি, প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক এলাকা, হাকালুকি হাওড়ের একাংশ। পূর্বে কুলাউড়া হতে শাহবাজপুর হয়ে যে ট্রেন লাইন ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত ছিল, তা আবার চালু হতে যাচ্ছে।
জুড়ীতে একটি রেলস্টেশন হবে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, মৌলভীবাজার এর এলএ কেস নং-১/২০১২-২০১৩ মূলে জুড়ী উপজেলার বাছিরপুর মৌজায়, কুলাউড়া-বড়লেখা সড়কের সঙ্গে ১.০০ একর জমি জুড়ী থানার নামে অধিগ্রহণ করা হয়।
পুলিশ বিভাগের একশত একটি জরাজীর্ণ থানাভবন টাইপ প্ল্যানে নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ছয়তলা ভিতবিশিষ্ট
চারতলা আধুনিক জুড়ী থানাভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৫-২০১৬ অর্থ সনে দরপত্র আহŸান করা হয়। ৭,৩১,৪৪,৩৫০ (সাত কোটি একত্রিশ লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার তিনশত পঞ্চাশ) টাকা ব্যয়ে থানাভবনটি নির্মিত হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে রয়েছে অফিসকক্ষ ও আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধাদি। বন্যা ও করোনার কারণে ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে বিলম্ব হয়। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খান এমপি, মাননীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী জনাব মোঃ শাহাব উদ্দিন এমপি মহোদয়ের উপস্থিতিতে আজ ০৯ অক্টোবর ২০২১ খ্রি. শনিবার জুড়ী থানাভবনের উদ্বোধন করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জুড়ী থানা ভবননির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
প্রতি তলায় ৬৫০০ বর্গফুট আয়তনের চারতলা ভবনের সামনে রয়েছে সবুজ মাঠ ও সুদৃশ্য ফুলের বাগান। থানা আঙিনায় প্রবেশের মুখেই বামপাশে রয়েছে একটি নয়নাভিরাম ছোট পুকুর। থানার সেবা প্রত্যাশীগণ থানা আঙ্গিনা ও ভবনে প্রবেশের পর এর আয়োজন দেখে মুগ্ধ হবেন। বর্তমানে যারা জুড়ী থানা পুলিশে কাজ করছেন এবং ভবিষ্যতেও যারা কাজ করবেন তাদের কাছে প্রত্যাশা, সুন্দর ভবনে অবস্থান করে জনগণকে উন্নত ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রæত ও কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিত করবেন।
জুড়ী থানা ভবন উদ্বোধন উপলক্ষ্যে ‘একটি আধুনিক থানার জন্মকথা’ শিরোনামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সিলেট রেঞ্জ পুলিশ ও মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের তত্ত¡াবধানে। গ্রন্থটিতে মৌলভীবাজার তথা জুড়ী থানা এলাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। সচিত্র ও তথ্য সংবলিত আকারে সফলতার সঙ্গে থানা পুলিশের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে বেশ কিছু করণীয় বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। এটি করতে গিয়ে বাস্তব জ্ঞান ও আইনের দিকটি মাথায় রাখা হয়েছে। থানায় কর্মরত এবং থানায় নবাগত পুলিশ সদস্যগণ বইটি পাঠ করে জুড়ী থানা এলাকা ও থানা পুলিশিং বিষয়ে সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারবেন। পুলিশ সদস্যগণের পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে বইটি সহায়ক হবে। সাধারণ পাঠকও বইটি পড়ে জুড়ী এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যসহ পুলিশি কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবেন।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নত করার লক্ষ্যে পুলিশকে উন্নত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি মহোদয় এ ধারাকে বেগবান করার জন্য দিনরাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যগণ নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, সরকারের দিঙ্নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন।
লেখক : ডিআইজি, সিলেট রেঞ্জ
স্বাঃ/
মোঃ জেদান আল মুসা
পুলিশ সুপার
রেঞ্জ ডিআইজি’র কার্যালয়, সিলেট।