৩ আগস্ট, রাজধানীর মগবাজারে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের নিচতলায় প্রশাসনিক কক্ষ। ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালের কত তলায় রাখা হচ্ছে- জানতে চাইতেই উপস্থিত দুই প্রশাসনিক কর্মকর্তা একে অপরের মুখ চাওয়া শুরু করলেন। প্রশ্ন বুঝতে পারেননি, এমন সন্দেহ থেকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করতেই তাদের একজন কিছুটা নরম স্বরে বললেন, পুরো হাসপাতালেই ডেঙ্গু রোগী। আপনি যে কোনও দিকে, যে কোনও ফ্লোরে যেতে পারেন।
এবছর শিশুরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। সে হিসাবে হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল এক ও দুই নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীতে পূর্ণ। এ দুই ওয়ার্ডে বিছানা রয়েছে আটটি করে মোট ১৬টি, যেগুলোর প্রত্যেকটিতে শিশু রোগী। তাদের সবার হাতে ক্যানোলা লাগানো। কেউ ঘুমিয়ে রয়েছে, কেউ আধশোয়া হয়ে মায়ের হাতে খাচ্ছে, কেউ আবার একহাতে ক্যানোলা নিয়ে আরেক হাতে মোবাইলে ভিডিও গেমস খেলছে।
এদের মধ্যে চিকিৎসা নিচ্ছে ১৬ মাস বয়সী শিশু রায়ান হাসান। হাতে ক্যানোলা লাগানো, মোবাইলে কার্টুন ভিডিও ছেড়ে তাতে মগ্ন রেখে মুখে তুলে খাওনোর চেষ্টা করছেন মা শাহানা আক্তার ডলি। খিলগাঁয়ের এই বাসিন্দা ডলি জানালেন, ছেলেকে নিয়ে ছয়দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন তারা। একমাত্র সন্তান রায়ান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড-২ এ চিকিৎসা নিচ্ছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মেহজাবিন আনোয়ার মৃত্তিকা। গত ২৫ জুলাই রাত থেকে জ্বর ছিল তার, সঙ্গে প্রচণ্ড গায়ে ব্যথা আর বমি। পরের দিন টেস্ট করানো হলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে তার। ২৭ জুলাই চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পর ২৮ জুলাই এ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় মৃত্তিকাকে।
রায়ান ও মৃত্তিকার মতোই এ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে শিমলা, তাসফিয়া আমিন, আরিয়ান মাহফুজ তাজোয়ারসহ আরও অনেক শিশু।
হাসপাতালের মেট্রন গোলাপী হালদার বলেন, চলতি বছরে মার্চের আগেও একজন, দুজন করে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তবে গত এপ্রিল থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সে থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৯ জন।
হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা. আনোয়ার কলি বলেন, ওয়ার্ডের ২৪টি বেড, কেবিন, গাইনি ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু রোগীদের রাখা হয়েছে। ৩ আগস্ট সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ছয়জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে, শিশু হাসপাতালের তথ্য জানাচ্ছে, ৩ আগস্ট পর্যন্ত এ হাসপাতলে মোট ১৪৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। কেবলমাত্র গত সাতদিনেই ভর্তি হয়েছে ৫২ জন আর আইসিইউতে রয়েছে ছয় শিশু। এ হাসপাতালে ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত চার শিশু মারা গেছে বলে জানিয়েছেন শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ।
এ দুটির মতো রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, আগস্টের চারদিনে ১ হাজার ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় (৪ আগস্ট পাওয়া তথ্য) শনাক্ত হয়েছে ২৩৭ জন। এদের মধ্যে ২২১ জনই ঢাকার আর ঢাকার বাইরে ১৬ জন।
অধিদফতর আরও জানায়, সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১ হাজার ৫৮ জন রোগী ভর্তি। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছে ১ হাজার ৪ জন, আর বাকি ৫৪ জন দেশের অন্যান্য বিভাগে। আর চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৮৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ছাড়া পেয়েছেন ২ হাজার ৬১৭ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে নয়জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে তিনজন, মে মাসে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন আর জুলাইতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২ হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
আর এ অবস্থার মধ্যেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও আশঙ্কাজনক রূপ নিতে পারে বলে উদ্বেগের কথা কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাই জ্বর হলে এখন করোনার নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা করানোর জন্যও পরার্মশ দিয়েছে অধিদফতর।
অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কারও যদি জ্বর থাকে তাহলে কোভিড পরীক্ষার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে হবে। সারা দেশে সিভিল সার্জনদের কাছে পর্যাপ্ত এনএস-১ কিট সরবরাহ করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত পরীক্ষা করানো সম্ভব হবে।
অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘বর্ষাকালে আমরা গত কয়েক বছর ধরেই দেখেছি— এডিসবাহিত যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি, সেটি সময় সময় অত্যন্ত আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। ২০১৯ সালে আমরা দেখেছি, ডেঙ্গু পরিস্থিতি আমাদের কীভাবে আক্রান্ত করেছিল। ২০২১ সালে এসে একই রকম একটি পরিস্থিতির মুখে আমরা দাঁড়িয়েছি। আমরা মনে করি, দ্রুত ব্যবস্থা নিলে সেটি মোকাবিলা করতে পারবো।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপের তথ্যমতে, নির্মাণাধীন ভবনের জমে থাকা পানি, প্লাস্টিকের ড্রাম, বালতি, পানির ট্যাংক, বাড়ি করার জন্য নির্মিত গর্ত, টব, বোতল ও লিফটের গর্তে এডিসের লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে। অধিদফতরের আরেক মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, এসব জায়গায় নজরদারি বাড়াতে হবে।
জরিপে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড, লালমাটিয়া, সায়দাবাদ এবং উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকায় এডিসের লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, চিকিৎসকরাও বলছেন, ঢাকায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। করোনার এই সময়ে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কেউ বুঝতে পারছে না। নীরবেই বাড়ছে। এখনই নজর দেওয়া না হলে পরিস্থিতির অবনতি হবে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং চিকিৎসকরা ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেছেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে এবং প্রায় ১২শ’ রোগী ইতোমধ্যে ভর্তি হয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, তারা ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল করছেন। কারন, করোনা এবং ডেঙ্গু রোগীদের একসঙ্গে একই হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়।
তবে দেশে যে এবার ডেঙ্গুর প্রার্দুভাব বেড়ে যাবে সে বিষয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, গত জুন মাসেই এ বিষয়ে আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু ভয়াবহ হবে- আগেই বলেছিলাম। আর এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গত মে এবং জুন মাসে একটা ‘প্রেডিকশন মডেল’ করেছিলেন বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আদ্রতা এবং এডিস মশার ঘনত্বের ট্রেইন নিয়ে। আর এসবের সঙ্গে মেলানো হয় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, রোগী কীভাবে বাড়ছে-এসব কিছু। আর এতে দেখা গিয়েছিল, এটা অনেক উপরের দিকে উঠে যাবে, অর্থ্যাৎ জুলাই থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বাড়তে থাকবে। আমরা বলেই দিয়েছিলাম, আগস্ট মাসে এটা ভয়াবহ হবে।
আর এই মুহূর্তে এডিস মশার ঘনত্ব ঢাকা শহরে অনেক বেশি জানিয়ে ড. কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
মহল্লাভিত্তিক কমিটি করতে হবে ডেঙ্গু নির্মুল কমিটি, যেখানে সিটি করপোরেশনের ক্লিনার, লার্ভার স্প্রে ম্যান আর ফগার মেশিন চালককে সম্পৃক্ত করারও পরামর্শ ড. কবিরুল বাশারের। তিনি বলেন, একটি করে টিম করে যদি মহল্লাভিত্তিক কমিটি করে চিরুনি অভিযান চালাতে হবে এবং সেটা করতে হবে সত্যিকারের চিরুনি অভিযান। নয়তো রক্ষা হবে না।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

বার্তা বিভাগ প্রধান