Home » আল কদর : হাজার রাতের চেয়ে উত্তম

আল কদর : হাজার রাতের চেয়ে উত্তম

মুহম্মদ নূরুল ইসলাম:ভূমিকা

‘লায়লাতুল কদর’ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। এই রাতটি হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। এই রাতেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন করিম নাজিল করা হয়েছে। কুরআন করিমের ‘সুরা আল কদর’-এর কথা বলছি। রাব্বুল আলামিন সুরার প্রথম আয়াত তথা প্রথম বাক্যে স্পষ্ট করে বলেছেন “আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি কদরের রাতে।” শুধু ‘সুরা আল কদর’ নয়, রাব্বুল আলামীন কুরআন করিমের সুরা আল বাকারাহ্-এর ১৮৫ নম্বর আয়াতে এব্যাপারে এরশাদ করেছেন এভাবে, “রমযান মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।” সুরা দুখানে এটাকে মুবারক রাত বলা হয়েছে। এখানে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, “অবশ্যি আমি একে একটি বরকতপূর্ণ রাতে নাযিল করেছি।” (সুরা দুখান, আয়াত নম্বর ৩)।

লাইলাতুল কদরের রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার হেরা পর্বতের গুহায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল কুরআন করিম অবতীর্ণ হয়।

আল কুরআন করিম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। আসমানি এক শ সহিফা, চারখানা কিতাবসহ মোট এক শ চারটি কিতাবের মধ্যে কুরআন করিমই সেরা। কারণ, এই কিতাব নাজিল হয়েছে আখেরি নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, নবীগণের ইমাম, রাসুলদের সরদার, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি।

নামকরণ
সুরার প্রথম আয়াতের ‘আল কদ্র’ শব্দটিকে এর নাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আরবি শব্দ ‘আল কদ্র’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘মহিমান্বিত’। তবে সুরার প্রথম আয়াতের ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দটাই কিন্তু আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। এই ‘লায়লাতুল কদ্র’‎ শব্দের অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা, মহাসম্মান বা মহিমান্বিত। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হচ্ছে; ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা। ইসলাম ধর্ম অনুসারে, এ রাতে মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মান বৃদ্ধি করা হয় এবং মানবজাতির ভাগ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়।

এই ‘লায়লাতুল কদ্র’ উপ-মহাদেশে ‘শবে কদ্র’ নামের বেশি পরিচিত। ‘শবে কদর’ ফার্সি শব্দ। ‘শব’ মানে রাত বা রজনী আর ‘কদর’ মানে সম্মান, মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য ইত্যাদি। শবে কদর অর্থ হলো মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। যে রাতে পবিত্র আল কুরআন করিম নাজিল হয়েছে, সে রাতই লাইলাতুল কদর। আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘নিশ্চয়ই আমি কুরআন করিম নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে।

কদরের আরেক অর্থ তকদির এবং আদেশও হয়ে থাকে। এ রাত্রিতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয়, এমনকি এ বছর কে হজ¦ করবে, তাও লিখে দেয়া হয়। হযরত ইবনে আব্বাস রা.-এর উক্তি অনুযায়ী চারজন ফেরেশতাকে এসব কাজ সোপর্দ করা হয়। তারা হলেন ইসরাফিল, মিকাঈল, আযরাঈল ও জিবরাঈল আ.। (কুরতুবী)

 

শানে নুযুল
ইবনে আবি হাতেম রা.-এর রেওয়ায়েতে আছে, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বনি-ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জেহাদে মশগুল থাকে এবং কখনও অস্ত্র সংবরণ করে নি। মুসলিমগণ একথা শুনে বিস্মিত হলে এ সুরা কদর অবতীর্ণ হয়। এতে এ উম্মতের জন্যে শুধু এক রাত্রির ইবাদতই সে মুজাহিদের এক হাজার মাসের এবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ইবনে জারির রহ. অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেন যে, বনি-ইসরাঈলের জনৈক এবাদতকারী ব্যক্তি সমস্ত রাত এবাদতে মশগুল থাকতো ও সকাল হতেই জেহাদের জন্য বের হয়ে যেত এবং সারাদিন জেহাদে লিপ্ত থাকতো। সে এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ্ তা’আলা সুরা-কদর নাযিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ থেকে আরও প্রতীয়মান হয় যে, শবে-কদর উম্মতে মুহাম্মদিরই বৈশিষ্ট্য। (মাযহারী)

 

সমস্ত ঐশীগ্রন্থ রমযানেই অবতীর্ণ হয়েছে
হযরত আবু যর গিফারি রা. বর্ণিত রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : ইবরাহিম আ.-এর সহিফাসমূহ ৩রা রমযান, তওরাত ৬ই রমযান, ইনজিল ১৩ই রমযান এবং যবুর ১৮ই রমযানে অবতীর্ণ হয়েছে। কুরআন করিম ২০ শে রমযানুল মুবারকে নাযিল হয়েছে। (মাযহারী)

 

সুরার বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
মুসলিমদেরকে আল কুরআন করিমের মূল্য, মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা এই সুরার আসল উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং এটাকে এই সুরার বিষয়বস্তু বলতে পারি।

প্রথমেই আল্লাহ্ বলেছেন, ‘আমি এটি নাযিল করেছি। অর্থাৎ এটি মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের রচনা নয় বরং আমিই এটি নাযিল করেছি’।

অতঃপর আল্লাহ বলেছেন, ‘কদরের রাতে আমার পক্ষ থেকে এটি নাযিল হয়েছে। কদরের রাতের দু’টি অর্থ। দু’টি অর্থই এখানে প্রযোজ্য। এক, এটি এমন একটি রাত যে রাতে তকদিরের ফয়সালা করা হয়। এটি সাধারণ রাতের মতো কোনো মামুলি রাত নয়। বরং এ রাতে ভাগ্যের ভাঙা গড়া চলে। এই রাতে এই কিতাব নাযিল হওয়া নিছক একটি কিতাব নাযিল হওয়া নয় বরং এটি শুধুমাত্র কুরাইশ ও আরবের নয়, সারা দুনিয়ার ভাগ্য পাল্টে দেবে। দুই, এটি বড়ই মর্যাদা, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের রাত। এটি হাজার মাসের চাইতেও উত্তম। এর সাহায্যে মক্কার কাফেরদেরকে পরোক্ষভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেশকৃত এই কিতাবকে নিজেদের জন্য একটি বিপদ মনে করেছো। তোমাদের ওপর এ এক আপদ এসে পড়েছে বলে তোমরা তিরস্কার করছো। অথচ যে রাতে এর নাযিল হবার ফায়সালা জারি করা হয় সেটি ছিলো পরম কল্যাণ ও বরকতের রাত। এই একটি রাতে মানুষের কল্যাণের জন্য এত বেশি কাজ করা হয়েছে যা মানুষের ইতিহাসে হাজার মাসেও করা হয় নি।

সবশেষে বলা হয়েছে, এই রাতে ফেরেশতারা এবং জিবরাইল আ. নিজেদের রবের অনুমতি নিয়ে সব রকমের আদেশ নির্দেশ সহকারে নাজিল হয়। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত এটি হয় পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার রাত। অর্থাৎ কোন প্রকার অনিষ্ট এ রাতে প্রভাব ফেলতে পারে না। কারণ আল্লাহর সমস্ত ফায়সালার মূল লক্ষ্য হয় কল্যাণ। মানুষের জন্য তার মধ্যে কোনো অকল্যাণ থাকে না। এমনকি তিনি কোনো জাতিকে ধ্বংস করার ফায়সালা করলেও তা করেন মানুষের কল্যাণের জন্য, তার অকল্যাণের জন্য নয়।

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব
পবিত্র রমযানে শেষ ১০ দিন নাজাতের ক্ষণ গণনা শুরু হয়। আর সে সাথে লাইলাতুল কদর গণনাও শুরু হয়ে যায়। তাই প্রতিটি মুসলমানের কাছে এই রাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও মহাসম্মানিত হিসেবে পরিগণিত। পবিত্র কুরআন করিমের বর্ণনা অনুসারে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এই একটি মাত্র রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর মাহে রমজানে এই মহিমান্বিত রজনী ‘লাইলাতুল কদর’ মুসলিমদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে।

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব আল্লাহ এ রাতকে সকল রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। পবিত্র আল কুরআন করিমে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ নিজেই। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইরশাদ করেন, “নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসুল প্রেরণকারী। তোমার রবের কাছ থেকে রহমত হিসেবে; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। যিনি আসমানসমূহ, জমিন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব; যদি তোমরা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকারী হও। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃ পুরুষদের রব। (সুরা আল দুখান, আয়াত : ৩-৮)

বরকতময় রজনী হলো লাইলাতুল কদর। আল্লাহ বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য। বরকতের প্রধান কারণ হল এ রাতে আল-কুরআন করিম নাজিল হয়েছে। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহ তা’আলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা অবতীর্ণ করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাঈল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করে। শান্তিময় সে রাত ফজরের সূচনা পর্যন্ত। (সূরা আল কদর, আয়াত : ১-৫)

আল-কুরআন করিমে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাত। তবে কুরআন করিমের ভাষ্য হলো লাইলাতুল কদর রমজান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনী রমযানের শেষ দশ দিনের মধ্যে হবে বলে সহিহ হাদিসে এসেছে। এবং তা রমযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদিসে এসেছে।

হাদিসে আছে, ‘রমাযানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো।’ (বুখারি : ২০২০, মুসলিম : ১১৬৯)

এবং রমজানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদিসে আছে, ‘তোমরা রমযানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ করো’। (বুখারি : ২০১৭)

অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে প্রথম হলো রমযান মাসের সাতাশ তারিখ। দ্বিতীয় হল পঁচিশ তারিখ। তৃতীয় হল ঊনত্রিশ তারিখ। চতুর্থ হল একুশ তারিখ। পঞ্চম হল তেইশ তারিখ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফজিলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে।

মুহাক্কিকগণ বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে নয়টি হরফ বা আরবি বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশে রমজানের রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। (তাফসিরে মাযহারি)

 

লাইলাতুল কদরে আমাদের করণীয়
ক. লাইলাতুল কদর একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ রাত। এই রাতে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য অর্জন করা সহজ। নফল নামাজের মধ্যে তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়লে ভালো আমল লাভ করা যায়।

আল কুরআন করিম তেলাওয়াত করা। বিশেষ করে কুরআন করিমের সুরা কদর, সুরা দুখান, সুরা মুয্যাম্মিল, সুরা মুদ্দাচ্ছির, ইয়া-সিন, সুরা ত-হা, সুরা আর রহমান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা।

তাসবিহ তাহলিলের মাধ্যমে রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন সম্ভব। বেশি বেশি দরূদ শরিফ পড়া, তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা, দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার ইত্যাদি করা, পিতা-মাতাসহ নিকট আত্মীয় ও বিশ^ মুসলিমের কবর জিয়ারত করা, নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সব মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনায় দোয়া করা।

খ. লাইলাতুল কদর হলো বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ক্ষমা চাওয়ার দোয়া। এ রাতে মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিলেন যে, ‘তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও, ক্ষমা পাওয়ার জন্য দোয়া করো’।

দুনিয়াতে একজন সফল মানুষ আখেরাতে সফল মানুষ হবে এমন নয়। সে যদি রাব্বুল আলামিনের ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবনটা ষোল আনাই মিছে। তাই এ রাতে অন্তরকে নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে খাঁটি অন্তরে তওবা ইস্তেগফার করতে হয়। খাঁটি তওবার চারটি শর্ত :
১. পূর্বের গুনাহ থেকে ফিরে আসা বা গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে;

২. গুনাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি;

৩. ভবিষ্যতে ওই গুনাহ আর করবো না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে;

৪. বান্দাহর কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে।

গ. এ রাতের আরেকটি আমল ওলামায়ে কিরামগণ বলেছেন যে, ইবাদাতের পূর্বে সন্ধ্যা বেলায় গোসল করে নিতে পারলে খুবই ভালো। উক্ত আমলগুলো শুধু ২৭ রমজান নয় বরং রমযানের শেষ দশ দিনের প্রত্যেক বেজোড় রাতে শবে কদর তালাশ করতে হবে। এজন্য মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করতেন। আর উম্মতের জন্য শরীয়তে ইতেকাফের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে গেছেন যেন তারা ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটি বেজোড় রাতে এবাদত করতে পারেন।

ইতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো লাইলাতুল কদর প্রাপ্তি; রমযানের শেষ দশক ইতেকাফ করলে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। ইতেকাফের মূল কথা হলো সবকিছু ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যাওয়া। হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ : ২৫, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা ২৯-৩০, হাদিস : ৩৪)

আল্লাহ তা’য়ালা লাইলাতুল কদরে কুরআন করিম নাজিল করেন। এ রাত বছরে মাত্র একবার আসে। কিন্তু এ রাতের মহান নিয়ামত কুরআন করিম মানব সমাজেই বিরাজমান থাকে চিরদিন। মানব জীবনে সাফল্য এই কুরআন করিমের আমলের উপরই নির্ভরশীল। এই রাতের মর্যাদা মূল্যায়ন তখনই যথার্থ হবে। যখন আমরা কুরআন করিমের নির্দেশিত পথে চলবো, আর কুরআন করিমের বাহক মুহম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করবো। এ রাতের সর্বাপেক্ষা মহৎ প্রাপ্তি হলো কুরআন করিমের হক আদায় করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে কুরআন করিম প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত করা।

 

সূরা আল কদর
এ রাতের ফজিলত, মর্যাদা, গুরুত্ব, বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন-

“১) আমি এ (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরের রাতে। ২) তুমি কি জানো লাইলাতুল কদরের রাত কি? ৩) লাইলাতুল কদরের রাত হাজার মাসের চাইতেও বেশি ভালো (শ্রেষ্ঠ)। ৪) ফেরেশতারা ও রূহ এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে নাযিল হয়। ৫) এ রাতটি পুরোপুরি শান্তিময় ফজরের উদয় পর্যন্ত।”

রাব্বুল আলামিন এখানে স্পষ্ট করে বলেছেন,“আমি একে নাযিল করেছি”। একে বলতে এখানে কুরআন করিমকে বুঝানো হয়েছে।

এ রাতেই প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর কুরআন করিম নাযিল নাযিলের সিলসিলা শুরু হয়েছে। সমগ্র কুরআন করিম এক সাথে নাযিল হয় নি। মক্কা মুয়ায্যমায় প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন তখন হযরত জিবরাইল আ. রাব্বুল আলামিনে পক্ষ থেকে ওহি নিয়ে আসেন। যা সূরা আল আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত। এই পাঁচটি আয়াত নাযিলের মাধ্যমে কুরআন করিম নাযিল শুরু হয়।

লাইলাতুল কদরের বিশেষ দোয়া
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে জানতে চান। হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর; তাহলে তখন আমি কোন দোয়াটি পাঠ করব?

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি বল-

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّى

(আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন কারিম, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।’)

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল দয়ালু। আপনি ক্ষমা করাকে ভালোবাসেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (তিরমিজি)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতে বেশি বেশি এ দোয়া পড়ার।

এ ছাড়াও আল্লাহ তা’আলার ক্ষমা লাভে কুরআনুল কারিমে তিনি বান্দার জন্য অনেক দোয়া তুলে ধরেছেন। যা নামাজের সেজদা, তাশাহহুদসহ সব ইবাদত-বন্দেগিতে পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আর তাহলো-

رَبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّاحِمِيْنَ

(‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতা খাইরুর রাহিমিন।’)

অর্থ : ‘হে আমার প্রভু! (আমাকে) ক্ষমা করুন এবং (আমার উপর) রহম করুন; আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ রহমকারী।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ১১৮)

رَبَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ

(‘রাব্বানা আমান্না ফাগফিরলানা ওয়ারহামনা ওয়া আংতা খাইরুর রাহিমিন।’)

অর্থ : ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। অতএব তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর ও আমাদের প্রতি রহম কর। তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ১০৯)

رَبِّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ فَاغْفِرْ لِيْ

(‘রাব্বি ইন্নি জ্বালামতু নাফসি ফাগফিরলি।’)

অর্থ : ‘(হে আমার) প্রভু! নিশ্চয়ই আমি নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি, অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৬)

رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

(‘রাব্বানা ইন্নানা আমান্না ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া ক্বিনা আজাবান নার।’)

অর্থ : হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং তুমি আমাদের গোনাহ ক্ষমা করে দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬)

رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ

(‘রাব্বানা জ্বালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন।’)

অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।’ (সুরা আল আরাফ : আয়াত ২৩)

رَبَّنَا اغْفِرْ لِيْ وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِيْنَ يَوْمَ يَقُوْمُ الْحِسَابُ

(‘রাব্বানাগফিরলি ওয়া লিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিলমুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’)

অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন তুমি আমাকে, আমার বাবা-মাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা কর।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৪১)

سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيْرُ

(‘সামিনা ওয়া আতানা গুফরানাকা রাব্বানা ওয়া ইলাইকাল মাসির।’)

অর্থ : ‘আমরা (আপনার বিধান) শুনলাম এবং মেনে নিলাম। হে আমাদের রব! আমাদের ক্ষমা করুন। আপনার দিকেই তো (আমাদের) ফিরে যেতে হবে।’ (সুরা আল-বাকারাহ : আয়াত ২৮৫)

رَبَّنَا وَلاَ تُحَمِّلْنَا مَا لاَ طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنتَ مَوْلاَنَا

(‘ওয়াফু আন্না ওয়াগফিরলানা ওয়ারহামনা আনতা মাওলানা ফাংছুরনা আলাল ক্বাওমিল কাফিরিন।’)

অর্থ : ‘হে আমাদের রব! যে বোঝা বহন করার সাধ্য আমাদের নেই, সে বোঝা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ো না। আমাদের পাপ মোচন করুন। আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রতি দয়া করুন। তুমিই আমাদের প্রভু।’ (সুরা বাকারাহ : আয়াত ২৮৬)

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِيْنَ سَبَقُوْنَا بِالْإِيْمَانِ

(‘রাব্বানাগফিরলানা ওয়ালি ইখওয়ানিনাল্লাজিনা সাবাকুনা বিল ঈমানি।’)

অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের ক্ষমা করুন এবং যারা আমাদের আগে যারা ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, তাদেরকেও ক্ষমা করুন।’ (সুরা হাশর : আয়াত ১০)

رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِيْ أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ

(‘রাব্বানাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া ইসরাফানা ফি আমরিনা ওয়া সাব্বিত আক্বদামানা ওয়াংসুরনা আলাল ক্বাওমিল কাফিরিন।’

অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিন। আমাদের কাজের মধ্যে যেখানে তোমার সীমালঙ্ঘন হয়েছে, তা মাফ করে দিন। আমাদের কদমকে অবিচল রাখুন এবং অবিশ্বাসীদের মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৪৭)

رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوْبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ

(‘রাব্বানা ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফফির আন্না সায়্যিআতিনা ওয়া তাওয়াফফানা মাআল আবরার।’)

অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! সুতরাং আমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করুন। আমাদের ভুলগুলো দূর করে দিন এবং সৎকর্মশীল লোকদের সাথে আমাদের শেষ পরিণতি দান করুন।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৯৩)

এক কথায় পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাতের সব ইবাদতই আল্লাহ তা’আলা কবুল করেন। আর এ রাতের সব ইবাদতই ফজিলতপূর্ণ। এ রাতে নফল নামাজ, কুরআন করিম তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরূদ, তাওবা-ইসতেগফারের গুরুত্ব অনেক বেশি।

তাই আল্লাহর ক্ষমা ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির জন্য লাইলাতুল কদরের উদ্দেশ্যে রমজানের বেজোড় রাতগুলো জেগে উল্লেখিত ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করা জরুরি। একই সাথে এ বেজোড় রাতগুলোতে বিগত জীবনের কাযা নামাজের কথা স্মরণ করে, ৫ ওয়াক্ত নামাজের কাজা আদায় করাও জরুরি।

 

লাইলাতুল কদরের নামাজ আদায়ের নিয়ম
রমজান মাসের শেষ দশ দিনের যে কোনো একটি রাত হল শবে কদর। এ রাতের ফজিলত অন্য যে কোনো রাতের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। বলা যেতে পারে- এ রাত হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে যত বেশি নফল নামাজ আদায় করবেন তত বেশি সওয়াব।

লাইলাতুল কদরের রাতে যত বেশি পারেন নামাজ পড়ুন, আল কুরআন করিম তেলাওয়াত করুন, জিকির ও দোয়া করুন। যেন আল্লাহ্‌ তা’য়ালা আপনার আগের গুনাহ মাফ করে দেন এবং রহমত ও বরকত দান করেন। এ রাত নামাজসহ বিভিন্ন ইবাদতের মধ্যদিয়ে কাঁটিয়ে দিন।

দুই দুই রাকাত করে নফলের নিয়ত করে সূরা আল ফাতেহার সাথে অন্য একটি সুরা মিলিয়ে নামাজ আদায় করা উত্তম ইবাদত। উত্তম হলো নফল নামাজ ধীরে সুস্থে লম্বা লম্বা ক্বেরাত দিয়ে পড়া এবং ধীরস্থিরে রুকু-সিজদা করা। ন্যূনতম আট রাকাত থেকে যত সম্ভব নামাজ পড়া যেতে পারে। কিছু ব্যতিক্রম নিয়মে সূরা আল ফাতেহার সঙ্গে ৩৩ বার সূরা আল কদর, ৩৩ বার আল ইখলাস পড়তে পারলে সবচেয়ে উত্তম ফজিলত পাওয়া যাবে।

“সুবাহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার” এ দোয়া পাঠ করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যাবে।

লাইলাতুল কদরের নামাজের নিয়ত :
“নাওয়াই তু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’য়ালা রাকাতাই সালাতিল লাইলাতিল কাদরি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার”। আরবি জানা না থাকলে বাংলা বলে নিয়ত করলেও নামাজ আদায় হবে। “আল্লাহ আমি লাইলাতুল কদরের দুই রাকআত নামাজ আদায় করার জন্য কিবলামুখি হয়ে দাঁড়ালাম, আল্লাহু আকবার।”

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪ রাকাত নামাজ কদরের রাতে আদায় করবে এবং উক্ত নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা আল ফাতিহার পর ২১ বার করে সূরা আল ইখলাছ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’য়ালা ওই ব্যক্তিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ করে দেবেন এবং বেহেশতের মধ্যে এক মনোমুগ্ধকর মহল তৈরি করে দেবেন।’

অপর এক হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কদরের রজনীতে ৪ রাকাত নামাজ আদায় করবে এবং প্রতি রাকাতে সূরা আল ফাতিহার পরে সূরা আল ক্বদর ও সূরা আল ইখলাস তিনবার করে পাঠ করবে, নামাজ শেষে সিজদায় গিয়ে নিম্নের দোয়াটি কিছু সময় পাঠ করে আল্লাহর দরবারে যা-ই প্রার্থনা করবে তিনি তাই কবুল করবেন এবং তার প্রতি অসংখ্য রহমত বর্ষিত করবেন।’

দোয়াটি হলো : ‘সুবাহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’।

জিকির ও দোয়া : হাদিসে যে দোয়া ও জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো থেকে কয়েকটি নির্বাচিত করে অর্থ বুঝে বারবার পড়া যেতে পারে। ইস্তেগফার ও দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। কমপক্ষে ১০০ বার ইস্তেগফার ও ১০০ বার দরুদ পড়া যেতে পারে।

 

উপসংহার

রাব্বুল আলামিন কুরআন করিমের সুরা আল কদরসহ কয়েকটি সুরায় স্পষ্ট করে এরশাদ করেছেন, “আমি পবিত্র রজনীতে আল কুরআন করিম নাযিল করেছি।” আল্লাহ্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা মোয়ায্যমার হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান মগ্ন অবস্থায় সুরা আল আলাকের প্রথম যে আয়াতগুলো নাযিল হয় তা হচ্ছে এই পবিত্র রজনীতে। এই পবিত্র রজনীটা রমযান মাসে। তবে রমযান মাসের কোন দিন বা তারিখ স্পষ্ট করে বলা হয় নি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমযান মানের শেষ দশদিনে লাইলাতুল কদরের রাতকে তালাশ করো। তাও বিশেষ করে বেজোড় রাতে। বেজোড় রাত হলে আমরা দেখতে পাই মাত্র কয়েকটি রাত, আর তা হচ্ছে- ২০, ২২, ২৪, ২৬, ২৮ তারিখ দিবাগত রাত তথা ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ রমযান।

এই পবিত্র রজনীতে এক হাজার মাসের অধিক মর্যাদা, গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো মুসলিম এই পবিত্র রজনীতে ইবাদত, বন্দেগি করে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের চেষ্টা করলে তাদের আমলনামায় এক হাজার মাসের সওয়াব লিখা হবে। ফলে আমাদের উচিত এই রাতকে খোঁজা। ফজর পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশে ফেরেশতাকূলের সর্দার হযরত জিবরাইল আ.সহ ফেরেশরাতা সপ্তম আসমান থেকে প্রথম আসমানে নেমে আসবেন এবং আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভের চেষ্টাকারী বান্দাদের আমলনামায় সওয়াব লিখে দেবেন। শুধু তাই নয়, যে যা চাইবে তাকে তাই দেওয়া হবে বলে আল্লাহ সুরা আল কদরে এরশাদ করেছেন।

তাই মুসলিমদের উচিত, সেজদায় গিয়ে তাসবিহ পড়ে কিংবা শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ ও দরূদ পড়ার পর নিজেদের গোনাহ থেকে মুক্তির জন্য আল কুরআন করিমে বর্ণিত দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়া।

আল্লাহ তা’আলা আল কুরআন করিমে ঘোষিত মর্যাদাবান রাত লাইলাতুল কদরে ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে পরকালের কামিয়াবি ও জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তির তাওফিক দান করুন। বিগত জীবনের গোনাহ মাফে আল্লাহর দরবারে কান্না ও রোনাজারি করার তাওফিক দান করুন। একই সাথে আমাদের কর্তব্য হলো বেশি বেশি নিজের জন্য আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দোয়া করা।

বুখারি ও মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

“যে ব্যক্তি কদরের রাতে ঈমানের সাথে এবং আল্লাহ্র কাছ থেকে প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদাতের জন্যে দাঁড়ালো তার পিছনের সমস্ত গোনাহ মাফ করা হবে।”

হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “সুরা আল ক্বদর ৪ বার পাঠ করলে এক খতম কুরআন করিমের সওয়াব আমলনামায় লেখা হবে।” (দুররে মনসুর ৬ষ্ট, পৃ ৬৮০)

আল্লাহ সকল মুসলিম উম্মাহকে লাইলাতুল কদর তালাশ করার তৌফিক দান করুন। প্রত্যেক মুসলিমকে লাইলাতুল কদরে কবুল করুন, লাইলাতুল কদর লাভের তাওফিক দান করুন।

আমিন, ইয়া রাব্বুল আলামিন।

লেখক : গবেষক, ইতিহাস লেখক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী।
islamcox56@gmail.com

সাহায্যকারী গ্রন্থসমূহ :
পবিত্র কোরআনুল করীম, মূল : তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ সাফী রহ., অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। খাদেমুলÑহারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক সংরক্ষিত । পোস্ট বক্স নং-৩৫৬১ মদীনা মোনাওয়ারা।
তাফহীমুল কুরআন, ১৯শ খণ্ড, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী র., অনুবাদ : আবদুল মান্নান তালিব। আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা। ২৩তম প্রকাশ মার্চ ২০১০।
তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন (অষ্টম খণ্ড), মূল লেখক : মুফতী মুহাম্মদ শফী এবং বাংলায় অনুবাদ মুহিউদ্দীন খান। পৃ : ৮৮৬ (পঞ্চম সংস্করণ)। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক জুন ২০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত।
তাফসীরে ইবনে কাছীর, ইমাম আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনে কাছীর র.Ñ অনুবাদ অধ্যাপক মাওলনা আখতার ফারূক, একাদশ খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ (রাজস্ব), আগস্ট ২০১৩।
ইসলামী বিশ^কোষ।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *