দেশে জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে রাশিয়ার স্পুটনিক ভি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুমোদন পাওয়া টিকার সংখ্যা দাঁড়ালো দুটি। শিগগিরই অনুমোদন পেতে যাচ্ছে চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিন। তবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের দৌড়ে এগিয়ে আছে স্পুটনিক ভি। আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদান প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে চীনের সিনোফার্ম। টেকনিক্যাল কমিটির পর্যালোচনায় এগিয়ে রয়েছে স্পুটনিক ভি টিকা। এখন ভরসা রাশিয়ার তৈরি এই ভ্যাকসিনেই।
বেক্সিমকোর মাধ্যমে সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি টিকা কেনার চুক্তি করেছিল সরকার। গত নভেম্বরে সম্পাদিত ওই চুক্তি অনুযায়ী সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে বাংলাদেশে প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা আসার কথা ছিল। এরপর জানুয়ারি মাসেই রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে প্রায় এক হাজার তিনশ কোটি টাকায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উৎপাদিত তিন কোটি ডোজ টিকা সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনার অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। চুক্তির পর সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে দু’টি চালানে এ পর্যন্ত মাত্র ৭০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে গত জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে। এরপর পাশাপাশি ৩২ লাখ ডোজ উপহার হিসেবে এলেও চুক্তি অনুযায়ী আর কোনও টিকা পায়নি বাংলাদেশ।
সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে টিকা রফতানি বন্ধ করে রেখেছে ভারত। জুন-জুলাইয়ের আগে টিকা সরবরাহ অনিশ্চিত বলেও জানিয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। যার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকেও টিকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
টিকার সরবরাহ না থাকায় দেশের স্টকে এখন ভাটা পড়ে গেছে। প্রথম ডোজ নেওয়া সবাই দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয় । তাই প্রথম ডোজ দেওয়া গত সোমবার থেকে বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিকল্প উৎস খুঁজতে চীন ও রাশিয়ার প্রস্তাবকে প্রাধান্য দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন সক্ষমতা এই মুহূর্তে রাশিয়ার না থাকার কারণে বাংলাদেশেই ফারমাসিউটিক্যালস কোম্পানির মাধ্যমে ভ্যাকসিন উৎপাদনে রাজি হয় রাশিয়া। এই ক্ষেত্রে শর্ত ছিল ভ্যাকসিনের ফর্মুলা কোনওভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। বাংলাদেশ সেই ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে রাশিয়ার কাছে পাঠিয়েছে। এটিকেই প্রাথমিক সমঝোতা চুক্তি বলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ইতোমধ্যে রাশিয়ার ভ্যাকসিন পেতে সক্ষমতা আছে এমন কয়েকটি দেশীয় ফারমাসিউটিক্যালস কোম্পানির নাম রাশিয়ার কাছে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে ইনসেপটা ফারমাসিউটিক্যালসসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি। সক্ষমতা অনুযায়ী রাশিয়া যাদের পছন্দ করবে তারাই উৎপাদন করতে পারবে স্পুটনিক ভি। তবে রাশিয়ার ফর্মুলাতে দেশে উৎপাদিত এই ভ্যাকসিনের নামকরণ একই থাকবে নাকি বদলে যাবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে সূত্রটি। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ওষুধ, পরীক্ষামূলক ওষুধ, টিকা ও মেডিকেল সরঞ্জামবিষয়ক কমিটি রাশিয়ার ভ্যাকসিনের সলিউশন নাকি পাউডার দেশে এনে উৎপাদন করা হবে তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কমিটি জানিয়েছে টিকা আনার ক্ষেত্রে এখনও অনেক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন দুটি মাধ্যম থেকে তৈরি হয়। একটি সলিউশন এবং আরেকটি হচ্ছে পাউডার। রাশিয়ার ভ্যাকসিন তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি জানায়, ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তিতে তৈরি এই ভ্যাক্সিন দুটি উপায়ে প্রস্তুত করা যায়। একটি হচ্ছে ‘রেডি টু ইউজ সলিউশন’ এবং অপরটি হচ্ছে ‘ফ্রিজড ড্রাইড পাউডার’। ‘রেডি টু ইউজ সলিউশন’ মাইনাস ১৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয় এবং ‘ফ্রিজড ড্রাইড পাউডার’ ২-৮ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে হয়। পাউডারটি পানিতে গোলানোর প্রয়োজন হয় সলিউশান তৈরি আগে। রাশিয়ার এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানায়, লিকুইড ফরমুলেশন তৈরি করা হয়েছে ব্যাপক হারে ব্যবহারের জন্য , এর উৎপাদন খরচ কম এবং সহজেই তৈরি করা যায়। অন্যদিকে পাউডার উৎপাদন সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হলেও সহজে বহনযোগ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়ে এই ভ্যাকসিনকে রাখলেও এখন পর্যন্ত জরুরি ব্যবহার্য তালিকায় স্থান দেয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তারা ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সির সঙ্গে যৌথভাবে স্পুটনিক ভি’র রিভিউ শুরু করবে মে মাসে। তাছাড়া গত ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতসহ ৬২টি দেশ এই ভ্যাকসিন জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর জানায়, মে মাসেই রাশিয়া থেকে ৪০ লাখ ডোজ টিকা আসার সম্ভাবনা আছে। রাশিয়ার টিকা কেনার পাশাপাশি তাদের প্রযুক্তি এনে দেশে টিকা উৎপাদন চুক্তির প্রক্রিয়াও এগিয়েছে অনেক দূর। পাশাপাশি চীন উপহার হিসেবে দেবে ৬ লাখ ডোজ টিকা। তাছাড়া কোভ্যাক্স থেকে আসবে ফাইজারের ১ লাখ ডোজ টিকা। এ ছাড়া ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তির বাকি টিকার চালান থেকে ২০ লাখ ডোজ আনার চেষ্টা চলছে। সংকট সমাধানে এক উৎসে নির্ভর না থেকে বিকল্প ব্যবস্থা করছে সরকার।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ২৪ এপ্রিল এ টিকা ব্যবহারের অনুমোদনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন করা হয়েছিল। মঙ্গলবারের টেকনিক্যাল কমিটির সভায় তা অনুমোদন পেল। আমরা এ টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিলাম। এখন এটা বাংলাদেশে আমদানি ও ব্যবহারে কোনও বাধা রইলো না।
তিনি আরও বলেন, এটা এখন আমদানি করা হবে। আর সেটা হবে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে। সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করে এর কার্যক্রম চলবে। কত সংখ্যক ডোজ, এর দাম কত হবে সবকিছু নির্ধারণ করবে সরকারের এ সংক্রান্ত কমিটি।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন বাংলাদেশে উৎপাদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আমাদের তিনটি ফার্মাসিউটিক্যালস ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস, পপুলার এবং হেলথ কেয়ার ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে। আমাদের দেশে এটা তৈরি করা যায় কিনা সে বিষয়ে ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যাল ইতোমধ্যে এ নিয়ে কথা বলেছে রাশিয়ার সঙ্গে। আমাদের দেশেও এই ভ্যাকসিন তৈরি হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আমরা ইতোমধ্যে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৫ লাখ ভ্যাকসিন আমাদের উপহার দেবে। তার জন্য যে কাগজপত্র প্রয়োজন আমরা তা পাঠিয়েছি। এখন অপেক্ষায় আছি চীন কবে এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পাঠাবে। নতুন টিকার অনুমোদনের বিষয়ে আমরা ওষুধ প্রশাসনকে বলে দিয়েছি। সেই প্রক্রিয়া পালন করে অনুমোদনের ব্যবস্থা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে চীনের সিনোফার্ম আর রাশিয়ার স্পুটনিক ভি আবেদন করেছিল। রাশিয়ার সঙ্গে আমরা ইতোমধ্যে চুক্তি করেছি। স্পুটনিক ভি নিয়ে আমরা রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা কিছু টিকা এমনিতেই দিতে পারে। তাদের টিকা তৈরি করার সক্ষমতা কম। আমাদের দেশে তারা উৎপাদন করতে চায়। আমাদের যদি সেই সুবিধা এবং সক্ষমতা থাকে। এই বিষয়গুলো তারা আবার নিজেরা দেখবে। তারপর আশ্বস্ত হয়ে তারা উৎপাদনে যেতে পারে। সেটি আমরা করার জন্য গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছি। আমাদের দুই একটা কোম্পানির সেই সক্ষমতা আছে। রাশিয়ানরা নিজেরা দেখবে কাদের সক্ষমতা ভালো তারাই তা নির্বাচন করবে।
বার্তা বিভাগ প্রধান