Home » ভোট যুদ্ধে করোনা এখন মমতার নতুন অস্ত্র

ভোট যুদ্ধে করোনা এখন মমতার নতুন অস্ত্র

জয়ন্ত ঘোষাল : করোনা আবহে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! করোনার ওয়েভ ওয়ানের থেকে, এখন এই দ্বিতীয় পর্যায়ের ওয়েভটা আরও ভয়ঙ্কর! রাজনীতি এমন একটা জিনিস, যেখানে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ ছাড়া রাজনীতি জমে না। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে করোনা একটা নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। তিনি বলেছেন, গতবছর যখন এখানে কোভিড-১৯ স্ফীতি দেখা গেছে তখন কিন্তুকোনও বিজেপি নেতা এখানে এসে কারোর খেয়াল রাখেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি অভিযোগ করেছেন, নরেন্দ্রমোদির ভুল রণকৌশল এবং পশ্চিমবঙ্গের দাবি-দাওয়া নামানার জন্য এই কোভিড এখন আরও বেশি করে ছড়াচ্ছে। আসুন, আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগগুলো এক এক করে আলোচনা করি।

অভিযোগ নম্বর ১ – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কবে থেকে বলে আসছেন, ভোট আসছে। পশ্চিমবঙ্গে তাড়াতাড়ি কোভিডের ভ্যাকসিনেশন পাঠানো হোক। তিনি বিনা পয়সায় সমস্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে, হাসপাতালের মাধ্যমে মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ায় ব্যবস্থা করে দেবেন। অপেক্ষা করে করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু ভ্যাকসিনেশন এলো না। কিন্তু এমন একটা সময় ভ্যাকসিনেশন পাঠানো হল, যখন ভোটের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ভোটটাতো শুধু মমতার নয়, বিজেপিরও একজন প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একজন মন্ত্রীরও তো একটা দায় আছে! পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করারজন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করা হয়েছে।

অভিযোগ নম্বর ২ – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকটা জনসভায় এই অভিযোগগুলো করতে শুরু করেছেন যে, স্বাস্থ্যপরিষেবার জন্যে, কোভিড মোকাবিলার জন্যে,পরিকাঠামোর উন্নতির জন্যে যে টাকাটা দেওয়ার কথা সেই টাকাটা দেওয়া হয়নি। কাজেই, অনেক কষ্ট করে হলেও সমস্ত ব্যবস্থা রাজ্য সরকার একাই করেছে। কেন্দ্র কোনওরকম দায়িত্ব নেয়নি। খালি বড় বড় কথা বলছে।

অভিযোগ নম্বর ৩ – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আউটসাইডারদের জন্য সরাসরি এই অভিযোগটা করে বলেছেন, এই যে বিজেপির নেতারা দলে দলে এখানে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী আসছেন, তাঁর সঙ্গে দলে দলে কত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা এসেছেন, যাঁদের মধ্যে কোভিড পজিটিভ পাওয়া গেছে। অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বিরাট নিরাপত্তাবাহিনী নিয়ে আসছেন। কত সাংসদ আসছেন, বিজেপির কত এমএলএ আসছেন, কত নেতা আসছেন, কত ব্যবসায়ী আসছেন। হোটেলগুলো সমস্ত বুক হয়ে গেছে। এতলোকের একসঙ্গে কলকাতায় আসা-যাওয়া, থাকা আর আর প্রচারকরা, এগুলো কিন্তু করোনা ছড়াতে বিশেষভাবে সাহায্যকরেছে।

অভিযোগ নম্বর ৪ – পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে দুর্নীতি হয়নি। বরং কেন্দ্র টাকা দেয়নি, সেই টাকার অভাব থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সমস্ত কিটস, যেগুলোকরোনার জন্য প্রয়োজন হয়, সেগুলো সুষ্ঠুভাবে বন্টন করেছে।

অভিযোগ নম্বর ৫ – প্রধানমন্ত্রী এক একটা জনসভাতে ভাষণ দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি একবারও দেখছেন না যে, বিজেপির এই এত জনসভা করার ফলে কিরকমভাবে কাতারে কাতারে মানুষ মাস্ক ছাড়াই সেখানে আসছে! এই একই অভিযোগ তো বিজেপিও মমতা সম্পর্কে করছে। তাদের অভিযোগ, মমতার যে জনসভাগুলো তো তাহলে বন্ধ হওয়া দরকার। তা না হলে এখানেও তো একইরকমভাবে করোনা ছড়াচ্ছে। মমতা বলছেন, আমি নিজে মাস্ক পরছি এবং আমি চেষ্টা করছি, যাতে সকলে মাস্ক পরেন। মমতা সরাসরি নির্বাচনকমিশনকেও অভিযোগ করে বলছেন, নির্বাচন কমিশন ইচ্ছে করলে এই তিনটে পর্যায়ের ভোটগুলোকে একসঙ্গে যুক্ত করে দিলে, ভোটের শেষ পর্যায়টাকে আরও তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়া যেত।

অমিত শাহ বলেছেন, এটা ঠিক নয়। কারণ, এর মধ্যেএকটা সাংবিধানিক দিক আছে। অর্থাৎ, প্রার্থীরা যখন মনোনয়ন করে, তার পরের একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যাবধানে ভোট করতে হয়। সেই ব্যবধানটা ছাড়া ভোট হবে কী করে? সুতরাং এই প্রশ্নটার উত্তর হল, কোনও সদিচ্ছার অভাব নয়, আসলে এটা সাংবিধানিক! কাজেই, মমতা যাই অভিযোগ করুন না কেন, ভোটটা ওইসময়ই করতে হবে।

বিজেপির জাতীয় সভাপতি কৈলাশ বিজয়বর্গীয় মমতার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলে বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভ্যাকসিনেশন নিয়ে রাজনীতি করছেন। পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমানে ভ্যাক্সিন পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব ব্যাপারে রাজনীতি করা বন্ধ করাউচিত। কোনও রাজ্য তো কমপ্লেন করেনি এই ব্যাপারে! শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভা নির্বাচনের আগে এইভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি করছেন।

নির্বাচন কমিশন এখন যেটা করেছে, বড় বড় সভা বন্ধ করে দেওয়া, ছোট ছোট সভাতে চলে যাওয়া, পরপর রোড শো হবে, কিন্তু সেগুলোকে খুবই অল্প লোকের মধ্যে করতে হবে। কত লোক আসবে, সেই সংখ্যাও বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। এখন কিন্তু নির্বাচনের প্রচারটা অনেকটাই টেলিভিশন এবং স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই করোনার ফলে কী তাহলে ভোট দিতে আসা মানুষের সংখ্যাটাও কমে যাবে? সবমিলিয়ে এটা কিন্তু একটা দেখবার বিষয়! তবে একটা কথাবলা যায়, ব্লেম গেম রাজনীতির বৈশিষ্ট্য, যা এবারেও হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, ২ মে এর পর বোঝা যাবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করোনাকে কেন্দ্র করে দোষারোপ করার যে অস্ত্র, সেই অস্ত্রটা কাজে লাগলো কী লাগলো না!

তবে এটা দেখা যাচ্ছে দেশের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে তার জনসভার কর্মসূচি কাটছাঁট করছেন | তিনি দুদিনের সভাগুলিকে একদিনে সারছেন | তাছাড়া সব বড় সভা বাতিল করা হয়েছে |

ভয়ংকর কোভিডের দ্বিতীয় ঝড় আছড়ে পড়েছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি করোনায় মানুষ কিভাবে মারা যাচ্ছে। প্রায় দুমাস পর কলকাতা থেকে দিল্লি এলাম। বিমানবন্দরে নামতেই দেখি করোনা পরীক্ষার বিস্তর আয়োজন। আমাদের নানান রকমের পরীক্ষা নিরিক্ষার মধ্যে দিয়ে বেরোতে হল। মুম্বই থেকে আসা যাত্রীদের করোনা সংক্রান্ত নেগেটিভ রির্পোট দেখাতে হবে। তবেই তারা দিল্লিতে প্রবেশের ছাড়পত্র পাবে। আমার চোখের সামনে বিভিন্ন বয়সের মানুষ সেই রিপোর্ট দেখাতে না পারায় তাদের মুম্বই ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল। দিল্লি পৌঁছে শুনলাম, আমাদের বাড়ির কাছের যে শশ্মান, নিজামুদ্দিনের কাছে, সেখানে করোনায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে যায়, যে সেখানে স্থানাভাব তৈরি হয়। ফলে শশ্মানের বাইরে রাজপথে মৃতদেহদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। কলকাতায় যে দুমাস ছিলাম খুব অবাক হয়ে দেখছিলাম, যে বেশিরভাগ জায়গায়ই মানুষ করোনার নিয়মকানুন কিছু মেনে চলে না। সর্বত্রই একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব। শান্তিনিকেতনে নববর্ষ
পালন উৎসবে কেউ কোনরকম মাস্ক না পরে হাজির হয়েছে। সে দৃশ্য টিভিতেই দেখা গেল। আমি থাকতাম দমদমের আড়াই নম্বর গেটের কাছে, মতিলাল কলোনির কাছে । সেখানে যখন সকালে চা খেতে যেতাম তখন দেখতাম প্রায় কারুরই মুখেই মাস্ক নেই। এই সাধারণ জনজীবন থেকে শুরু করে কলেজস্ট্রিট, পার্কস্ট্রিট সর্বত্রই একই ছবি। এমনকি নন্দীগ্ৰামে কিংবা উত্তরবঙ্গে নির্বাচন দেখতে গিয়েও দেখেছি মিছিলে, রোড-শো তে, জনসভায় খুব কম মানুষই মাস্ক পরে আসছে বা নিয়মকানুন মানছে। এদিকে করোনা কিন্তু বেড়েই চলেছে।

মার্চ মাসের শুরু থেকেই ১০০০ থেকে ২০০০ নতুন কেস প্রতিদিনই দেখা দিয়েছে। প্রত‍্যেক দিন ইনফেকশন এবং নতুন নতুন কেস বাড়তে বাড়তে মার্চ মাসের শেষে ৭০০০ থেকে ৮০০০ হয়ে যায়। ১ এপ্রিলের মধ্যে গোটা দেশে ৬,১০,৯২৭ টা অ্যাক্টিভ কেস হয়ে যায়। ৬ই এপ্রিল ভারত দেখলো ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১,১৫,৩১২ টার মতো কেস হয়েছে। এই মহামারী এমন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে, যা আমরা কখনো দেখিনি। এই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নতুন এবং বড় নির্মম।

আমাদের দুর্ভাগ্য এসবের মধ্যেই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে পাঁচটা রাজ‍্যে ভোট হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে আট দফায় ভোট হয়েই চলেছে। সেই কবে ভোট শুরু হয়েছিল, যেনো মনে হচ্ছে, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা। প্রতিনিয়ত কলহ, মারামারি, গুলিচালনা, মৃত্যু, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, সন্ত্রাস। আর এইসবের মধ্যে হয়ে চলেছে গণতন্ত্রের সবথেকে বড় পরীক্ষা নির্বাচন। মানুষ উত্তেজিত। যেনো জীবন-মরণপণ। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই, যে করোনায় আক্রান্ত হলে কী হবে ? করোনায় মৃত্যুর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন হবে না প্রত‍্যাবর্তন হবে সে প্রশ্নের উত্তর জানা।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *