শুদ্ধবার্তাটোয়েন্টিফোর:
আধুনিক ও সমৃদ্ধ মালয়েশিয়া গড়ে উঠেছে মাহাথির মোহাম্মদের হাত ধরেই। তবে নির্বাচনের আগে তিনি বলেছেন, মালয়েশিয়াকে নতুন করে সাজাতে এখনও কিছু কাজ বাকি। ২২ বছরের শাসনামলে কিছু ভুল করেছেন বলেও কান্নাভেজা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন মাহাথির। চেয়েছেন সংশোধনের সুযোগ। এখন প্রশ্ন, মালয়েশিয়ার জনগণ তাকে সেই সুযোগ দেবে কিনা। নির্বাচন পূর্ববর্তী জরিপগুলো বলছে ‘না’। যে দলের হয়ে ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির, জরিপে সেই দলের প্রার্থী নাজিব রাজাকেরই ক্ষমতায় ফেরার আভাস মিলেছে। সুবিধা মতোন নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণও করে নিয়েছেন এই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বিরোধী জোটকে নৃতাত্ত্বিক চীনা জনগোষ্ঠীর দল আখ্যা দিয়ে মাহাথিরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়ীদের বিপরীতে স্থাপন করার ‘বিভক্তির রাজনীতি’ও করেছেন তিনি। নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে সম্প্রতি একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে মালয়েশিয়ায়। সেখানে এক মেয়েকে মাহাথিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। ভিডিওতে কান্নাভেজা চোখে মাহাথির মেয়েটিকে বলছেন, ‘বয়স হয়েছে, আমার আর বেশি সময় নেই। মালয়েশিয়াকে নতুন করে সাজানোর জন্য আমার আরও কিছু কাজ বাকি আছে; সম্ভবত বিগত শাসনামলে আমি কিছু ভুল করেছি, সেগুলো শোধরাতে হবে।’ নির্বাচনে জিততে পারলে মাহাথির মোহাম্মদ সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক সরকার প্রধান হবেন। যে দলের হয়ে ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির, এবার সেই দলের বিরুদ্ধেই নির্বাচন করছেন তিনি। মাহাথির নির্বাচন না করলে তা অনেকটা একপেশে হয়ে যেত বলে মনে করা হয়। কিন্তু তার উপস্থিতিতে মালয়েশিয়ান জনগণকে মাহাথির অথবা মালয়েশিয়ার উন্নয়নকারী সরকারের দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন-ইউএমএনও এর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। তবে বিভিন্ন কারণে ক্ষমতাসীন বারিসন ন্যাসিওনালকেই এগিয়ে রাখছে জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলো। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপ বলছে, নাজিবের জয়ের সম্ভবনা ৮৫ শতাংশ। স্বাধীন জরিপকারী প্রতিষ্ঠান মারদেকা সেন্টার গত সপ্তাহে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে শাসকদেরই জয়ের সম্ভাব্যতা হাজির করেছে। ওই জরিপের ফলাফলে বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়ার আাভাস মিললেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ক্ষেত্রে নাজিবের দলকেই এগিয়ে রাখা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও সরকারি দলের সমর্থনে কাজ করেছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। কাগজে-কলমে কমিশন স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও পোস্টাল ব্যালটের অপব্যবহার করা হয়েছে বলেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কেন সপ্তাহান্তে না করে সপ্তাহের মাঝখানে ফেলা হলো, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কার্যত ছয় জন বিরোধী নেতাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেছে কিছু প্রশ্ন সাপেক্ষ ‘টেকনিক্যাল’ ইস্যুতে। ১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকে মালয়েশিয়ার যে নাটকীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সেটার কৃতিত্ব সরকারি দলেরই। মালয়েশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয়ী জনগণের দরিদ্র অংশ সেই ৮০ ও ৯০ দশকের উন্নয়নের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী। দেশের সামগ্রিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই মালয়ী। বিরোধীরা মালয়ীদের আকর্ষণ করতেই মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন। তাদের ধারণা ছিল তিনি এই ভোট আকর্ষণ করতে পারবেন। তবে প্রচারণার মধ্য দিয়ে নাজিব ওই জনগোষ্ঠীকে কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। সে সময় মাহাথির সরকারের নেতৃত্বে থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণায় প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক দুই দশকের উন্নয়নকে দলীয় কৃতিত্ব আকারে জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন। দেশের চীনা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে বিভক্তির রাজনীতির হাতিয়ার করতেও সমর্থ হয়েছেন তিনি। বরাবরই এই জনগোষ্ঠীর ঝোঁক বিরোধীদের দিকে। ২০১৩ সালে এথনিক চীনাদের প্রায় সব ভোট পড়েছিল বিরোধীদের বাক্সে। মাহাথির সেই বিরোধীদের জোট থেকে নির্বাচন করায় তাকে চীনা জনগোষ্ঠীর প্রতি অনুরক্ত আকারে হাজিরের চেষ্টা করেছেন নাজিব। কিন্তু মালয়ীরা যেখানে মোট জনসংখ্যার ষাট শতাংশ, সেখানে নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে তাদের ভূমিকাই প্রধান হবে। এতে মাহাথিরের মালয়ীদের নিরঙ্কুশ ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি হবে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাহাথির মোহাম্মদ যেভাবে সরকার বিরোধীদের দলে ভিড়েছেন, তাতে বিরোধী জোটকে সরকারের চেয়ে ভালো মনে করছেন না ভোটাররা। তারা হয়তো মাহাথির মোহাম্মদের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে মনে রাখবে, কিন্তু সরকারকে অসন্তুষ্ট করতে চাইবে না। চলতি বছর মার্চে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে সংসদীয় সীমানা পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্তে সম্মতি দেন আইন প্রণেতারা। একে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত আখ্যা দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকস গত এপ্রিলে বলেছিল, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধানের বছরে নাজিবের জয়ের সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে। আসনের সীমানা সংশোধনের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকারের জন্য অনেক সহজ হবে।