রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে শুয়ে শুয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই পড়ছিলাম। লাবণ্যও খাওয়া শেষ করে রুমে আসলো। পুরনো অভ্যাসে বিছানায় আসার আগে একটু আধটু সাজগোজ করে নিচ্ছে। পারফিউম মাখছে। খেয়াল করে দেখলাম আজকে একটু বেশিই সাজগোজ করছে। কারণটা বুঝতে পারছিলাম না। তাই একটু মজা করেই বললাম ‘এতো রাতে কারো সাথে দেখা করতে যাবে নাকি’? লাবণ্য কিছুই বললো না। খেয়াল করলাম তার হাসিমাখা মুখ ম্লান হয়ে যাচ্ছে, সাজসজ্জার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। হাতের চুড়ি খুলে নিচ্ছে, কপালের টিঁপ খুলে আয়নার লাগিয়ে রেখে দিচ্ছে, চোখে টেনে দেয়া কাজলে- জমে যাচ্ছে আকাশের সমস্ত মেঘ। তড়িগড়ি করে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে লাবণ্যের হাতটা ধরলাম। তাতেই সে কান্না শুরু করলো। বাচ্চা মেয়েদের মতো কান্না। লাবণ্য ঠিক আগের মতোই প্রচন্ড অভিমানী রয়েগেছে। খুব বিশ্বাস করে আমায়। ভালোবাসা বলতে আমাকেই বুঝে।
কান্না থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম-আজ এতো গাঢ় সাজগোজের কারণ কি?
— নাকো নাকো কণ্ঠে অভিমানীভাবে বললো, একটু ছাদে যাবো। ইচ্ছে করছে তোমাকে সাথে নিয়ে জ্যোৎস্না দেখি। কতদিন হয়- ছাদে যাই না, জ্যোৎস্না দেখি না। মনটা খুব ক্লান্ত হয়ে আছে। ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে একটু সময় দেই।
–লাবণ্যের কথায় রাজি হলাম, ভাবলাম সত্যিই তো। মাঝে মাঝে নিজেকেও সময় দিতে হয়। আবেগহীনভাবে চললে এই ইট পাথরের শহরকে- শহর নয় জঙ্গল মনে হয়। এর মধ্যে লাবণ্য তৈরি হয়ে আসলো। এমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে আজ- যেন আমি ছাড়া এই সাজগোজ আর কাউকে দেখাবেই না সে। দু’জন ছাদে গেলাম। লাবণ্য বলে উঠলো।
–দেখ শুভ্র, কিছু কিছু গান আছে, যেগুলো শুনলে হৃদয় নিশ্চুপ হয়ে যায়। একদম নিশ্চুপ। এই যেমন- রবীন্দ্রনাথের “তুই ফেলে এসেছিস কারে- মন মনরে আমার, তাই জনম গেল শান্তি পেলি না” গানটি শুনলে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। মনে হয় সবকিছুই আছে আবার সকল কিছুই হারাচ্ছি। ভালোবাসা না পেলে মানুষ সত্যিই কি ভিখারী হয়ে যায় শুভ্র? যদি কভু আমায় কষ্ট দাও তাহলে ঐ জ্যোৎস্নার প্রান্তরে আমি চলে যাব। একেবারে নির্বাসনে…
–লাবণ্যের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার মজা করে বললাম, তোমার চোখের কাজলে আমি ভালোবাসা হয়ে থাকবো। যখন মন খারাপ হবে তখন অশ্রু হয়ে তোমার ঠোঁটে লুটিয়ে পড়বো। তুমি আমায় আজন্ম পান করবে।
–লাবণ্য আবার কান্নাভরা কণ্ঠে বললো, তুমি সহস্র কথার গাঁথুনি দিয়ে আমার মন খারাপ করিয়ে কি সুখ পাও বলতো শুভ্র? এমনভাবে বলো যেন আমি তোমার কেউ না।
–শুভ্র আলতো করে লাবণ্যের হাত চেপে ধরে বললো-কষ্ট পেলে হৃদয় শক্ত হয় আর ভালোবাসার গভীরতা বাড়ে।
–এর মাঝে রাত ১২.০১ মিনিট হলো। লাবণ্য একটা হাতঘড়ি উপহার দিয়ে শুভ্রকে হাতে পরিয়ে দেয়। তারপর একটা ফুল হাতে দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো-শুভ জন্মদিন শুভ্র। হাজার বছর পাশে থেকো।
–শুভ্র স্তম্ভিত ও ভীষণ খুশি হয়ে বললো, এজন্যই বুঝি এতো বাহানা করে ছাদে নিয়ে এসেছো আমায়। লাবণ্যকে বুকে টেনে নিয়ে বললো- জীবনটা নেহাৎ মন্দ নয় লাবণ্য। মন্দ নয়।