বাংলাদেশে বেশির ভাগ আইনই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত। ব্রিটিশ শাসকরা তাঁদের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ মজবুত করার অসদুদ্দেশ্যেই ঐ সকল আইন করেছিল।ঐ আমলের কিছু আইন সংশোধন করা হলেও অনেকগুলোই অসংশোধিত রয়ে গেছে। আবার আইনের ফাঁক বন্ধ করতে নিয়মিত সংশোধন করা দরকার বলে মনে করেন অনেক আইনজ্ঞ। কারণ আইনের ফাঁক গলে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়,অন্যদিকে হয়রানির শিকার হয় নিরীহ মানুষজন। তাহলে বলা যায় আইন যেমন অভিযুক্তকে সাজা পেতে সহযোগীতা করে তেমনি বেকসুর খালাস পেতেও সহায়তা করে। প্রকৃতই কি ইহা আইনের ঘোরপ্যাঁচ নাকি অপব্যবহার??বিশদ আলোচনায় যাওয়া যাক।
বাংলাদেশে ‘আইনের ঘোরপ্যাঁচ ’শব্দটির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। অভিযোগ আছে কখনো কখনো আইনের প্যাঁচ কাটিয়ে এ দেশে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়৷ আবার অভিযোগ আছে বিনা বিচারে,বিনা অপরাধে কারাভোগেরও। কদিন আগে আমি নিজেই এ প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়েছি।।
♦বাংলাদেশে ফৌজদারি আইনের মামলায় বাদী/প্রতিপক্ষ আসামির শাস্তি দাবি করেন৷ অন্যদিকে দেওয়ানি আইনের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়৷ সাধারণভাবে খুন,জখম,হত্যা,হত্যাচেষ্টা,সন্ত্রাস,ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধের মামলা হয় ফৌজদারি আইনে৷ আর প্রধানত জমি জমা, সম্পত্তি নিয়ে এবং পদের অধিকারে বিরোধের মামলা হয় দেওয়ানি আইনে৷ এই দু’ধরনের আইনের মামলা তদন্ত, পরিচালনা আর বিচারের জন্য আছে আরো আইন৷ সিভিল প্রসিডিউর কোড এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড ছাড়াও সাক্ষ্য আইন এখানে মূল ভূমিকা পালন করে৷ ♦দেওয়ানি মামলায় যেহেতু শাস্তি নয় অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়, তাই কোনো পক্ষ তার দাবি শতকরা ৫০ ভাগের বেশি প্রমাণ করতে পারলেই তাঁর পক্ষে রায় পাবেন।অর্থাৎ Civil Law is compensatory…. আবার Criminal Law is Punitive..ফৌজদারি আইনের মূল দর্শন হলো: এ আইনের অধীনে কোনো মামলা হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করতে হয়৷ এ আইনে কোনো সন্দেহ রেখে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না৷ আসামিরা সব সময়ই ‘Benifit of Doubt”-এর সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ কারণ এই আইনে ন্যূনতম সন্দেহ রেখেও কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না৷ এখানে অপরাধ প্রমাণ মানে এক শতভাগ প্রমাণ৷
♦বাংলাদেশে আইনের ঘোরপ্যাঁচ হিসেবে সাধারণত ফৌজদারি আইনের মামলা বা অপরাধ সম্পর্কিত উদাহরণ দেয়া হয়৷ বাংলাদেশের বিচার কার্যক্রম চলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী। শাস্তির বিধানসংবলিত প্রচলিত দণ্ডবিধিতে আসামি করা হলে দুই ধরনের ধারায় তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কিছু ধারা আছে জামিনযোগ্য। কিছু ধারা আছে জামিনের অযোগ্য। জামিনের অযোগ্য ধারার অপরাধগুলো সাধারণত মারাত্মক অপরাধ বলেই বিবেচনা করা হয়। আর ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের, তদন্ত, বিচার এবং রায় কার্যকর পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ আছে৷ মামলা দায়ের, তদন্ত এবং অভিযোগপত্র ( Charge sheet) এই তিনটি স্তর সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে কেবল পরবর্তীতে ন্যায়বিচার আশা করা যায়৷ যদি গোড়ায় গলদ থাকে তাহলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হতে পারে৷তবে ন্যায়বিচার শুধু মামলার বাদীর একার নয়, ন্যায়বিচার আসামির জন্যও প্রযোজ্য৷ তাই শুধু আইন-আদালত নয়, তদন্তকারী সংস্থাও পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে জড়িত৷ আইন প্রয়োগ এবং সে আইন বাস্তবায়ন এর প্রক্রিয়া ই আসলে আইনের চরিত্রকে প্রকাশ করে৷ আইনের ফাঁকফোকর,অপপ্রয়োগ,প্রয়োগ না হওয়া বিষয়গুলো কতগুলো সংস্থা বা বিভাগের ওপর নির্ভরশীল৷ একসময় রক্তের বদলে রক্ত বা খুনের বদলে খুনই ছিল বিধান। এমন কঠিন আইনের পরও ঐ আইনে রক্তের মূল্য পরিশোধ করার সুযোগ ছিল। নিহত কোনো ব্যক্তির রক্তের ঋণ শোধ করতে পারলে খুনি খুনের দায় থেকে অব্যাহতিও পেত। এ ক্ষেত্রে দেখা যেত বিত্তবান ও প্রভাবশালীরা খুনের দায় থেকে সরাসরি মুক্ত হয়ে যেত। সভ্য সমাজে আইন প্রণয়নের পরও একটি ফাঁক রেখে দেওয়া হয়, সেটি হলো রাষ্ট্রপতির ক্ষমা। এই সুযোগে রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি দেওয়া হয় অনেককে। কিছু কেইসহিস্ট্রি খেয়াল করি……
কেইসহিস্ট্রি – ১
২০১২ সালে মামার সঙ্গে মুগদা এলাকায় থাকতেন একজন অভিনেত্রী।আগস্টের এক মধ্যরাতে কাজ শেষে সহকর্মী অভিনেতা তাকে মোড়ে নামিয়ে দেন। মামা সেদিন বাইরে ছিলেন,চাবি ছিল সামনের দোকানে। আর দোকানটি ছিল বন্ধ। মেয়েটি সহকর্মীকে ফোন করলে তিনি ফেরত গিয়ে দারোয়ানসহ তালা খোলার চেষ্টা করেন। তালা খোলে না। দারোয়ান মেয়েটিকে নিজের পরিবারের কাছে রাখেন। আর রাত অনেক হয়েছে বলে ছেলেটিকে নিচতলার একটি ঘরে থাকতে দেন। ঘন্টাখানেক পর মেয়েটির নাম ধরে চিৎকার করতে করতে চার যুবক ওই বাসায় হামলা করেন। তারা ছেলেটিকে মারধর করেন। মেয়েটিকে খুঁজে বের করে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামান,তার গায়ে হাত দেন। তিনি ‘খারাপ কাজ’ করেন বলে মাসিক ১০ হাজার টাকা চাঁদা চান। তারপর উত্ত্যক্তকারীরা তাদের টাকা,ছেলেটির হাতঘড়ি ও এটিএম কার্ড নিয়ে চলে যান। তারা আগেও রাতে বাড়ি ফেরার পথে মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করতেন। এসব অভিযোগ এনে ১১ দিন পর ছেলেটি মামলা করেন। ট্রাইব্যুনাল-৫-এ চারজন উত্ত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলে ঐ ছেলে ও মেয়েটি এবং তদন্ত কর্মকর্তা(IO) সাক্ষ্য দেন। আরও সাক্ষ্য দেন দারোয়ান ও আরেক ভাড়াটে। দুজনই বলেন, চিৎকার-চেঁচামেচি শুনেছেন কিন্তু কাউকে দেখেননি,আসামিদের চেনেন না। অতঃপর ২০১৬ সালের মাঝামাঝি আসামিরা বেকসুর খালাস পান। কখনো হয়তো পীড়নের ডাক্তারি প্রমাণপত্র থাকে। কিন্তু মামলা ঝুলে গেলে অভিযোগকারী, ভুক্তভোগী বা সাক্ষীদের আদালতে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।
কেইসহিস্ট্রি – ২
গত বছর ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলা দৈনিক প্রথম আলো একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ সেই প্রতিবেদনে উঠে আসে ফাঁসি কার্যকরের একদিন আগে একজন আসামির দণ্ড কীভাবে স্থগিত হয় এবং তিনি কীভাবে জামিনে বেরিয়ে আসেন৷তিনি হলেন ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকির৷ মানসিক অসুস্থতার বাহানা করে তিনি ফাঁসি থেকে রেহাই পান৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের আসলাম ফকির ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সাহেদ আলী ওরফে সাহেব আলী মিয়াকে হত্যা করেন৷ দু’জনই ঐ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে এসেছিলেন পর্যায়ক্রমে৷জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসলাম ফকিরকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়৷ পরে হাইকোর্ট এ রায় বহাল রাখে৷ ২০১৩ সালের ১৯ মে খুনের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন আসলাম ফকির৷ কিন্তু ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর তা নামঞ্জুর হয়৷ ঐ বছরের ১৩ নভেম্বর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন ধার্য হয়৷ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি পাঠানো হয়৷কিন্তু ১২ নভেম্বর বন্দি আসলাম ফকির এমন আচরণ শুরু করেন,কারাগারের নথির ভাষায় যেটা ছিল ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘অসুস্থতা’৷ ফলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা হয় এবং ঐ দিনই দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করা হয়৷ দ্বিতীয় দফায় প্রাণভিক্ষার আবেদন গৃহীত হলে আসলামের দণ্ড হ্রাস করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি৷ তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷ বিশেষ দিবসে বন্দিদের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ নিয়ে চলতি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক চিঠি (ডিও লেটার) দেন সাংসদ নিলুফার জাফরউল্যাহ৷ ১৩ বছর দু’দিন কারাভোগের পর গত ২৫ আগস্ট গাজীপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মুক্তি পান আসলাম৷ কেইসহিস্ট্রি – ৩যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় চার্জশিটভূক্ত আসামি সাদমান ইয়াসির মাহমুদ হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ২০১৪ সালের ১ জুন৷ এরপর তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে যান৷ সাদমান হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে নিম্ন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিল৷ সাদমানের আইনজীবী হাইকোর্টে দাবি করেন,জবানবন্দিতে সাদমান অন্যদের জড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন৷ তিনি রাজীব হত্যায় জড়িত নন৷ এর ভিত্তিতেই তাকে জামিন দেয়া হয়৷ জানা গেছে, সাদমান একজন প্রভাশালী ব্যক্তির পুত্র এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল৷ ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরের পলাশনগর এলাকায় নিজ বাসার সামনে খুন হয়েছিলেন রাজীব হায়দার৷
কেইসহিস্ট্রি – ৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বাখরনগর গ্রামের বাবুল মিয়াকে ডাকাতির মামলায় ১৯৯২ সালে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ঢাকার ডেমরা থেকে সিআইডি পুলিশ তাকে যখন গ্রেপ্তার করে তখন তিনি ছিলেন ১৮ বছরের কিশোর৷ চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি যখন তাকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত খালাস দেয় তখন তার বয়স ৪৩ বছর৷ ঐ মামলায় তার শাস্তি হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হতো৷ কিন্তু বিনা বিচারে তাকে ২৫ বছর কারাগারে আটক রাখা হয়৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটা আদালতের নজরে না আনলে হয়ত বাবুলকে জেলেই মৃত্যুবরণ করতে হতো৷ ১৯৯২ সালের ২১ আগস্ট রাত ৮টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড়ে তিনি যাত্রী হয়ে একটি বাসে থাকাকালে একদল ডাকাত বাসে ডাকাতি করে৷ ডাকাতরা ডাকাতি করে চলে গেলেও বাসের হেলপার নজরুল ইসলাম সন্দেহবশত তাকে অভিযুক্ত করে ডেমরা থানায় একটি ডাকাতি মামলা করেন৷ পুলিশের ডেমরা থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আশ্রাফ আলী সিকদার তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন৷ কিন্তু বিচার শুরুর ২৪ বছরে মামলার ১১ সাক্ষীর মধ্যে আদালতে মাত্র ৪ জন সাক্ষ্য দেন৷ মামলার বাদি ও তদন্ত কর্মকর্তা কখনই আদালতে হাজির হননি৷
কেইসহিস্ট্রি – ৫
গত ১৯ অক্টোবর খুলনার খানজাহান আলী থানার আটরা পালপাড়ায় শেখ আব্দুল জব্বারের বাড়িতে ডাকাতি হয়৷ মুখোশধারী ডাকাত দল ঐ বাড়ির নীচ তলায় গেট ভেঙে প্রবেশ করে ও জব্বারের মেয়ে লিপি খাতুনের হাত-মুখ বেঁধে তাকে বেঁধে রেখে ডাকাতি করে৷ ডাকাতরা সোনা গয়নাসহ দুই লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়৷ কিন্তু পুলিশ ডাকাতির মামলা নেয়নি৷ লিপি খাতুনকে চুরির মামলা দিতে বাধ্য করে৷
উপরের পাঁচটি কেইসহিস্ট্রি থেকে দেখা যাচ্ছে যে আইনের ঘোরপ্যাঁচ নয় বরং এখানে আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে বা আইন মানা হয়নি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে যা বলেন তা হুবহু তুলে ধরা হল,,‘‘আইন যাঁরা প্রয়োগ করেন তাঁদের উপরই আইনের যথার্থতা নির্ভর করে৷ আইনের উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা৷তবে আইনে ত্রুটি থাকতে পারে৷আইনেরও অপব্যবহার হতে পারে৷আবার আইনের প্রয়োগ নাও হতে পারে৷ এমনকি নিবর্তনমূলক আইনও হতে পারে৷ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে তাতে মনে হতে পারে আইনে ফাঁকফোকর আছে৷ কিন্তু আইনের ছাত্র হিসেবে আমি আইনে ফাঁক ফোকর কথাটি গ্রহণ করতে পারি না৷
” তিনি বলেন, ‘‘৫৪ ধারা একটি নিবর্তনমূলক আইন হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ বিশেষ ক্ষমতা আইনও তেমন৷কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার হলে কিন্তু তা নাগরিকদেরও কল্যাণেই আসে৷ তাই উচ্চ আদালত এই আইনের ব্যাপারেও কিছু নির্দেশনা দিয়েছে যাতে বিনা অপরাধে,বিনা বিচারেও বা বিনা মামলায় আটক রাখা না যায়৷
” আইনের এই অধ্যাপক বলেন,‘‘বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় চারটি পক্ষ কাজ করে৷ পুলিশ, রাষ্ট্রপক্ষ, আদালত এবং কারাকর্তৃপক্ষ৷ এখন যে কোনো এক পক্ষের অদক্ষতা বা অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে আইনের অপপ্রয়োগ হতে পারে৷ অপরাধী ছাড়া পেয়ে যেতে পারে৷ আবার নিরপরাধ কেউ শাস্তি পেয়ে কারাগারে যেতে পারে৷” তিনি আরও বলেন,‘‘ঢাকার নিম্ন আদালতের মামলা পর্যালোচনা করেও দেখা গেছে যে সর্বোচ্চ ১৫-২০ ভাগ মামলায় আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেছে৷ ৮০ ভাগ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷ আর এর পিছনে নানা কারণ আছে৷ কিন্তু প্রধান কারণ হলো পুলিশের তদন্তে দুর্বলতা৷ বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়ে আদালত তা বলেছেন৷ এটা ইচ্ছা করে হতে পারে,আবার অদক্ষতার কারণেও হতে পারে৷ বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ময়নাতদন্তেও অসততার কথা বলেছে আদালত৷
” আসলে দেশে পুলিশের ক্ষমতা যে কত বেশি তা জানে কমবেশি সবাই। যেকোনো সময় যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে পুলিশের সবচেয়ে সহজ হাতিয়ার ৫৪ ধারা। ফৌজদারি কার্যবিধির এই ধারাবলে সন্দেহজনকভাবে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিতে পারেন।অবশ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ধারাটি সংস্কার করতে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত যা ১০ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে পূর্ণাঙ্গ রায় হিসেবে প্রকাশিত হয়।হয়তো এটি সংস্কার হবে। কিন্তু তারপরও কাউকে ধরতে ধারার অভাব হবে না পুলিশের। কারণ অনেক সময় পুলিশই বলে থাকে,”আকাশের যত তারা পুলিশের তত ধারা।
” এবার দেখা যাক বিভিন্ন পরিসংখ্যান কি বলেঃ
♦”নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন” আইনে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ আর সংঘবদ্ধ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এ আইনে শাস্তি দিতে হলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে হয়৷ প্রয়োজন হয় চিকিৎসা সংক্রান্ত সনদসহ অন্যান্য দালিলিক সাক্ষ্য৷ সঠিক সময় ডাক্তারি পরীক্ষা করা না হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না৷ দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চললেও ঘৃণ্য এই অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সাজার হার খুবই কম।পরিসংখ্যান অনুযায়ী,প্রতি বছর ধর্ষণের মামলার নিষ্পত্তি হয় ৪ ভাগেরও কম।
♦মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী,২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭৩২।অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ,যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে।আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী।
♦বেসরকারি সংস্থা ‘নারীপক্ষ’ গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মামলার মধ্যে ৯৮৯ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।খালাস পেয়েছে ২৮৯ জন।আর শাস্তি দেওয়া হয়েছে মাত্র পাঁচজনকে! বিচারাধীন রয়েছে ৩ হাজার ৮৯টি ধর্ষণের মামলা।
♦২০১৩ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন প্রণয়ন করা হয়৷ এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ নির্যাতনে মাধ্যমে কারো মৃত্যু হলে দায়ীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া যাবে৷শুধু নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে নির্যাতনের মাত্রা বিবেচনায় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে আইনে৷কিন্তু আইনে বলা হয়েছে,সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে৷ ফলে অপরাধী শুধু জরিমানা দিয়েই মুক্তি পেতে পারেন৷
♦আবার অস্ত্র এবং মাদক আইনের মামলায় অপরাধ প্রমাণ করতে হলে কোনো ব্যক্তির দখলে ঐ অস্ত্র বা মাদক পাওয়া জরুরি৷ কেউ ঐ অপরাধে জড়িত হওয়ার পরও তাদের কাছে বা দখলে না পাওয়া গেলে তারা আইনে সুবিধা পান এবং অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়৷আবার আইনের বিধানের কারণেই কারো পকেটে অস্ত্র বা মাদক দিয়ে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে দেয়া যায়৷
♦যৌতুক বিরোধী আইনে যৌতুক বলতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দেয়া যে কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বোঝাবে৷ তবে কোনো উপঢৌকন যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না৷আর এই উপঢৌকনের আড়ালেই চলে যৌতুক দেয়া নেয়া৷
♦মানহানির একই অপরাধে বাংলাদেশে দুই ধরনের আইন আছে৷পত্রিকা বা বইয়ে লিখে কারো মানহানি করলে তার শাস্তি ৫০০ ধারায় দুই বছরের জেল৷এই একই অপরাধ অনলাইন বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে করলে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন)এর ৫৭ ধারায় সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। ৫৭ ধারায় কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই তিনি মামলা করতে পারেন৷ এই অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় এই আইন দিয়ে হয়রানি ও মিথ্যা মামলা দেয়া যায়৷ অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন,‘‘কেউ যদি সঠিক তথ্য প্রমাণসহ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন তাহলেও তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়৷ আর যে কোনো ঘটনায় মিথ্যা মামলার সুযোগ তো আছেই৷ জামিন অযোগ্য মামলায়ও বিচারক যদি সন্তুষ্ট হন তাহলে জামিন দিতে পারেন৷ এখন প্রশ্ন হলো, বিচারক তথ্য প্রমাণসহ যৌক্তিক কারণে কি সব সময় সন্তুষ্ট হন?”
♦বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘আইনের Basic Principle হলো উভয় পক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা রক্ষা করা৷ এখন ফৌজদারি আইনে ১০০ টাকাও চুরি আবার ১০০ কোটি টাকাও চুরি৷১০০ টাকা চুরি করলে জেলে যাবেন আর ১০০ কোটি টাকা চুরি করলে ভিআইপি স্ট্যাটাস পাবেন৷এই Public Perception থেকে আইনের ফাঁকফোকরের কথা বলা হয়৷ মনে করা হয় আইনে অনেক মারপ্যাঁচ আছে৷ আসলে এটা আইনের প্রয়োগগত সমস্যা৷ ব্রিটিশরা এই আইন যখন করে তখন চুরির শাস্তি দেয়ার চেয়ে চোর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা ছিল বেশি৷১৮ শতকের ব্রিটিশ আইনকেই আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মীকরণ করেছি৷ কিন্তু সেই আইন দিয়ে বর্তমান সময়ের মানুষের মর্যাদা,মনন কোনোটাই ধারণ করা সম্ভব নয়৷
” তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন বলি আইনের শাসন না থাকলে এটা থাকবে না,ওটা থাকবে না৷ কিন্তু এই আইনের শাসন হলো একটা মিথ্যা আশ্বাসের জায়গা৷ কারণ যে Colonial আইন হয়েছে আপনাকে-আমাকে দমন-পীড়নের জন্য, সেই আইনগুলো বহাল থাকলে আপনার-আমার সম্মান, ন্যায়বিচার, মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে না৷ সেজন্য নতুন ‘Set off Law”-এর প্রয়োজন৷ নতুন আইনের প্রয়োজন৷
” তিনি আরো বলেন, ‘‘এছাড়া একই অপরাধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন ও সাজার বিধানসহ আইনে অনেক ‘Contradiction’ আছে,যা দূর করা প্রয়োজন…..
উপরের আলোচনা থেকে আমি মনে করি না যে আইনগত দুর্বলতার কারণে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হচ্ছে না।আমাদের দেশের আইন যথেষ্ট শক্তিশালী।পৃথিবীর অন্য দেশে আইন কম,প্রয়োগ বেশি। আমাদের দেশে আইন বেশি,প্রয়োগ কম। আবার কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে আইনের অপপ্রয়োগ। বস্তুতঃ আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা জটিল কোনো বিষয় হবে না।আরেকটি বিষয় হল,আমাদের দেশে যে পরিমাণ মামলা হচ্ছে ঐ পরিমাণ বিচারক এবং অবকাঠামো নেই। আরও বেশি পরিমাণ অবকাঠামো তৈরি এবং বিচারক নিয়োগ হলে, পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে অপরাধীর পার পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।
লেখিকা – আয়েশা সিদ্দিকা লোপা
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
বার্তা বিভাগ প্রধান