Home » করোনা : দেশে বাড়ছে সুখবরও

করোনা : দেশে বাড়ছে সুখবরও

করোনাভাইরাস নিয়ে চারদিকে শুধুই খারাপ খবরের ছড়াছড়ি। মৃতের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়ছে উপসর্গ দেখা দেওয়া বিভিন্ন রোগীর সংখ্যা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমন পরিস্থিতির মধ্যেই প্রতিদিন আসছে ভ্যাকসিন, ওষুধ ও চিকিৎসার কোনো না কোনো সম্ভাবনার খবর; যদিও এখন পর্যন্ত এর কোনোটি নিশ্চিতভাবে কার্যকর প্রমাণ দেখাতে পারছে না। সেই সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও অবনতি যেমন আছে আবার অগ্রগতিরও দেখা মিলছে। আবার প্রতিদিনই করোনার সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হওয়া বা সুস্থ হয়ে উঠা মানুষের সংখ্যাও দেশে বাড়ছে।

বাংলাদেশেও এমন কিছু আশা দেখাচ্ছে করোনা-চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি, পুরনো দুটি ওষুধে সাফল্য, একটি হাসপাতালে করোনাজয়ী ৪৬ চিকিৎসাকর্মীর রোগীদের সেবায় ফিরে আসা, একটি ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালে বিনা মূল্যে করোনা-চিকিৎসা, উপসর্গধারী রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ চালুর মতো বেশ কিছু কার্যক্রম। এর সঙ্গে দেশের প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন বিষয়টিও গবেষণার বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে দেশি-বিদেশি পর্যায় থেকে।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের যেমন হতাশা-আক্ষেপ আছে, তেমনি আশার আলো কিন্তু আমরা কিছু না কিছু দেখছি। শুরুর দিকে যেমন অগোছালো অবস্থা ছিল, সেটা কিন্তু এখন অনেকাংশেই কেটে গেছে। এর মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উদ্ভাবন, গবেষণা—এসব ক্ষেত্রেও আমরা অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে সত্যি সত্যি যদি বড় কোনো সাফল্য পেয়ে যাই সেটা যেমন আমাদের দেশের জন্য বড় ব্যাপার হবে, তেমনি সারা বিশ্বের জন্য বড় কোনো সুসংবাদ হবে।’

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ এই কাজগুলোকে অগ্রগতি হিসেবে দেখে এমন কাজের ক্ষেত্রগুলোকে আরো সম্প্রসারিত করার তাগিদ দেন। পাশাপাশি এসব উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর আহ্বান জানান। তবে সেই সঙ্গে তিনি বিভিন্ন থেরাপি ও ওষুধের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রটোকল অনুসরণ হচ্ছে কি না, সেদিকেও নজর রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি কোনো সাধারণ মানুষ যেন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজেরা কোনো ওষুধ ব্যবহার না করে সে ব্যাপারে সতর্ক করেন।

দেশে প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে করোনা-চিকিৎসার পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া গতকাল শনিবার থেকে শুরু হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। এই হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান ও প্লাজমা থেরাপি সাবকমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা আপাতত করোনাজয়ী দুজনের শরীর থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করেছি আমাদের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগে। যাঁদের প্লাজমা নেওয়া হয়েছে তাঁরা দুজনই চিকিৎসক। এখন আমরা দেখব তাঁদের ওই প্লাজমার নমুনায় উপযুক্ত মাত্রায় অ্যান্টিবডি আছে কি না। যদি পাওয়া যায়, তবে তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের শরীরে প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা নিরূপণ করা হবে।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আরো কয়েকটি দেশে এই প্লাজমা থেরাপি কার্যকর হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তাই আমরাও এই চেষ্টা করছি। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন ৪৫ জন গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীর ওপর তা প্রয়োগ করা হবে। এর আগে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবার কেয়ার হাসপাতালের একজন চিকিৎসক পরীক্ষামূলকভাবে প্লাজমা প্রয়োগ করেছিলেন।

এবার কেয়ার হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক ডা. আরিফ মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি এখনো একেবারেই প্রাথমিক গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। তাই এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত করে কিছু জানাচ্ছি না।’

বিশেষজ্ঞরা জানান, অ্যান্টিবডি থাকা প্লাজমা প্রতিস্থাপনে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। গত ৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় পরীক্ষামূলকভাবে এই প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের সুপারিশ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান গণমাধ্যমকে বলেন, রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞরা প্লাজমা থেরাপি নিয়ে কাজ করেন। তবে এ ক্ষেত্রে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রক্রিয়ার দিকে খুব করে নজর রাখতে হয়। আবার পদ্ধতিটি খুব সহজে কার্যকর হয়, সেটিও কিন্তু না। এ ক্ষেত্রে সংগৃহীত প্লাজমায় কতটুকু অ্যান্টিবডি থাকে সেটি যেমন জরুরি, তেমনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সব ধরনের রোগীকে আবার এটি দেওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের পরিমাপ আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত সম্মান ফাউন্ডেশনের আওতায় এক দল চিকিৎসক পুরনো অন্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত দুটি ওষুধের ব্যবহারের মাধ্যমে করোনা-চিকিৎসায় সাফল্য দাবি করেন গত শুক্রবার রাতে গণমাধ্যমে’র কাছে। এই খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর গতকাল দিনভর বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় ব্যাপক কৌতূহল। বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও চলে আলোচনা-পর্যালোচনা। দেশের প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তারেক আলম ও অধ্যাপক ডা. রুবাইয়ুল মোরশেদসহ তাঁদের সহযোগীরা প্রায় দেড় মাসের গবেষণায় এই নতুন আশার আলো দেখছেন।

ডা. আলম গণমাধ্যমকে জানান, তাঁরা করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা রোগীদের অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল মেডিসিন আইভারমেকটিনের সিঙ্গল ডোজের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগ করে মাত্র তিন দিনে ৫০ শতাংশ লক্ষণ কমে যাওয়া আর চার দিনে করোনাভাইরাস টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ আসার বিস্ময়কর সাফল্য পেয়েছেন। ডা. আলম বলেন, ‘এটি আমাদের কাছে রীতিমতো বিস্ময়কর লেগেছে। আরো আগে যদি আমরা ওষুধ নিয়ে কাজ করতাম, তবে এত দিনে হয়তো অনেককে হারাতে হতো না। এখন আমরা আনুষ্ঠানিক ট্রায়ালের প্রক্রিয়ার জন্য যা যা করা দরকার সেই পথে এগিয়ে যাব।’

অধ্যাপক ডা. রুবাইয়ুল মোরশেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যেহেতু আমাদের হাসপাতালটি কভিড, তাই আমরা আমাদের হাসপাতালের আউটডোরে কভিড-১৯-এর উপসর্গ নিয়ে যে রোগীরা এসেছে তাদের ওপর ওই ওষুধ ব্যবহার করে ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেছি। এটা একটা স্টাডি মাত্র; কিন্তু অফিশিয়াল কোনো ট্রায়াল নয়। আমরা আমাদের প্রাথমিক স্টাডি থেকে যে সাফল্য পেয়েছি, এখন আমরা ট্রায়ালের দিকে যাব সরকারের উপযুক্ত অথরিটির অনুমতি ও প্রটোকল মেনে।’ তিনি বলেন, ‘ওই ওষুধ দুটি এর আগেও সার্স মহামারির সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। ওষুধ দুটির সম্মিলিত ব্যবহারে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্য দুটি ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও রেমডিসিভিরের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ফল পাওয়া যাবে। এরই মধ্যে এই ওষুধ নিয়ে ভারতে গবেষণা শুরু হয়েছে। আমরা বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৬০ জন রোগীর ওপর স্টাডি করেছি। অস্ট্রেলিয়ার মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ওষুধ দুটির সফল স্টাডি সম্পন্ন হয়েছে।’

এদিকে আরেকটি ভালো খবর হচ্ছে, রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যে ১৬০ জনের বেশি চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন এবং কাজে যোগদান করতে শুরু করেছেন। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৪৬ জন করোনাজয়ী চিকিৎসক ও কর্মী রোগীর সেবায় আবার ফিরেছেন কর্মস্থলে। শনিবার কর্মস্থলে যোগ দিতে আসা এসব করোনাজয়ী চিকিৎসক ও কর্মীকে আমরা ফুল ও মাস্ক দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছি।’

অন্যদিকে গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনে শুধু উপসর্গধারী রোগীদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাদের এখনো নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট আসেনি কিন্তু তাদের উপসর্গ আছে, তাদের জন্য আমরা সম্পূর্ণ আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। ফলে এখন থেকে আর কোনো রোগীকে উপসর্গ নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে হবে না বলে আশা করছি; যদিও এর আগে আমরা পুরনো বার্ন ইউনিটে এমন উপসর্গধারীদের জন্য স্বল্প পরিসরে চিকিৎসা শুরু করেছি। নতুন ভবনে এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এখন সেই পরিধি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।’

এদিকে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে প্রাইভেট সেক্টরের আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি অংশে গতকাল থেকে শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য চিকিৎসাসেবা শুরু করা হয়েছে। এখানে কভিডে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করবে। রোগীর কোনো খরচ দিতে হবে না বলে জানিয়েছে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এতেশামুল হক চৌধুরী। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে ওই হাসপাতালে কভিড চিকিৎসার অংশ উদ্বোধন করেন।

এদিকে আরেকটি সুখবর আসছে আজ রবিবার। করোনা-চিকিৎসায় দেশের সর্ববৃহৎ অস্থায়ী হাসপাতাল হিসেবে আজ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় নির্মিত কভিড আইসোলেশন সেন্টার।

এদিকে রাজধানীর শ্যামলীতে আড়াই শ শয্যাবিশিষ্ট বক্ষব্যাধি হাসপাতালে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি এ ধরনের রোগীদের কারো পরীক্ষার রেজাল্ট পজিটিভ আসে তখন তাকে অন্য সরকারি কভিড হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবু রায়হান।

সৌজন্যে : কালের কন্ঠ

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *