সিলেটের জাফলং বেড়াতে গিয়ে অদূরে ভারতের যে পাহাড়ী শহরটি দেখা যায় সেটার নাম ডাওকি।আর ডাওকির পাশে পাহাড়ী উমগট নদীর উপর
দুই পাহাড়ে ঝুলে থাকা দৃষ্টি নন্দন যে ব্রিজটি সবার দৃষ্টি কাড়ে সেটাই ডাওকি ব্রিজ।জাফলং ভ্রমনকারীদের কাছে ডাওকি ব্রিজের রয়েছে আলাদা আকর্ষন।
কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা এই ব্রিজ তৈরীর ইতিহাস।এর সাথে জড়িয়ে আছে সিলেটের অনেক কৃতি মানুষের নাম। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই সেতুটি এখনো
সবার কাছে আকর্ষনীয়।যারা এই পথ দিয়ে শিলং বা ভারতে গেছেন তারা কাছ থেকে দেখেছেন চমৎকার এই ব্রিজটি। কিন্তু হয়ত জানেন না এই ব্রিজটির স্থপতি সিলেটের এক কৃতি সন্তান।
১৯১৯ সাল, অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতবর্ষ । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেড়াতে আসলেন উত্তর-পূর্ব ভারতের শৈলশহর শিলং’এ । শ্রীহট্টে এই খবর শুনে শুরু হলো গুরুদেবকে নিয়ে আসার তোড়জোর । বাঁধা হয়ে দাড়ালো শিলং-শ্রীহট্ট সড়ক ।কারন সরাসরি কোন সড়ক যোগাযোগ ছিলো না। চেরাপুঞ্জি হয়ে মানুষের পিঠে চড়ে পাহাড় থেকে নামতে হতো। এদিকে গুরুদেব মানুষের পিঠে চড়ে আসতে রাজি নন । যাই হোক্ অবশেষে গুয়াহাটি-বদরপুর-লাতু-কুলাউড়া আন্তঃসংযোগ রেলওয়েতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কবিগুরু শ্রীহট্টে পদার্পণ করলেন ।
এই ঘটনার পর পর শিলং শ্রীহট্র সরাসরি সড়ক যোগাযোগের বিষয়টি প্রথমে সবার দৃষ্টিতে নিয়ে আসেন কংগ্রেস নেতা ও আসাম প্রাদেশিক শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রী শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারের সন্তান খানবাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ ওরফে কাপ্তান মিয়া । কিছুদিন পর কাপ্তান মিয়া প্রয়াতঃ হোন । তখন থেকেই রাজ্যের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছিল শিলং-ডাউকি-তামাবিল-শ্রীহট্ট সড়ক নিয়ে । বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক । কংগ্রেস নেতা ও আসাম প্রাদেশিক সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী(প্রথমে পার্লামেন্ট স্পীকার, পরবর্তীতে মন্ত্রী) শ্রীহট্টের বরগঙ্গা গ্রামের(অধুনা বুরুঙ্গা) সন্তান বসন্ত কুমার দাসকে বিষয়টি যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলে । তিনি উদ্যোগ নেন রাস্তাটি নির্মাণের । মন্ত্রী বসন্ত কুমার দাসের অকৃত্রিম প্রচেষ্টায় অর্থবাজেটে সেটি বরাদ্দও হয়ে যায় । এগিয়ে আসে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সরকার । কিন্তু বাঁধা হয়ে দাড়ায় খাসি ও জৈন্তিয়া পাহাড়কে বিভক্তকারী খরস্রোতা ‘উমগট নদী’। বসন্ত বাবু প্রমাদ গুনলেন । এদিকে শ্রীহট্টের করিমগঞ্জের লাতুর (অধুনা, বড়লেখার শাহবাজপুর, পরবর্তীতে শহরের জিন্দাবাজারের কাজী ইলিয়াস এলাকার বাসিন্দা ) তরুণ ছেলে আবিদ রেজা চৌধুরী তখন ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ শিবপুর পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকৌশল শিক্ষা নিয়ে সবেমাত্র চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন । সেটা ১৯২৯ সালের কথা, এই আবিদ রেজা চৌধুরীই শ্রীহট্টের প্রথম মুসলিম প্রকৌশলী । আবিদ রেজার ডিজাইন ও নির্দেশনায় ১৯৩২ সালে পূর্ণতা পেল ডাউকির দর্শনীয় ঝুলন্ত সেতু
আর তার মধ্য দিয়ে চালু হলো শ্রীহট্র শিলং সরাসরি সড়ক যোগাযোগ।
উল্লেখ্য বৃটিশ ভারতে শ্রীহট্র ছিলো আসাম প্রদেশের একটি জেলা শহর আর শিলং ছিলো আসামের রাজধানী। ডাওকির উমগট নদীর উপর নির্মিত দৃষ্টি নন্দন এই
ব্রিজটি তখন বলা হতো Gateway Of Shillong. এই ব্রিজ নির্মানের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত হলো খাসি ও জৈন্তিয়া পর্বতমালা।উন্মোচিত হলো শ্রীহট্র শিলং যোগাযোগের নতুন দ্বার। এখানে বলা সমীচীন যে, শ্রীহট্টে সুরমা নদীর উপর নির্মিত ‘কীন্ ব্রিজ’ তৈরী হয়েছিল ১৯৩৬ সালে ।
এই ডাওকি ব্রিজের স্থপতি ও ডিজাইনার আবিদ রেজা চৌধুরী হলেন সদ্যপ্রয়াত সিলেটের কৃতি সন্তান প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর পিতা।
আজ ডাউকির ঝুলন্ত সেতুকে দেখতে হাজারো পর্যটকের ভীড়ে হয়তো কেউ জানেন না এই দৃষ্টি নন্দন সেতু তৈরীর ইতিহাস আর প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরীর নাম । আবিদ রেজা চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস ছিলো আসামের কাছাড় জিলার হাইলাকান্দিতে, যা এখন ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক ভ্যালীর অন্তর্গত।
বার্তা বিভাগ প্রধান