দেবব্রত রায় দিপন :যা হচ্ছে এবং যা হবে-তা সহজেই অনুমেয়। সে প্রসঙ্গে আলোচনা না বাড়িয়ে বরং আলোচনা হওয়া উচিত-কি করলে অন্তত প্রাণহাণীর পরিমান কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। এই মুহুর্তে আমি এবং আমরা সবাই একটি বিষয় নিয়েই আতঙ্কিত। আর তা হলো সর্বনাশ ঘাতক সংক্রামন ব্যাধি করোনা ভাইরাস। চিনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া এই ভাইরাস এখন ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বাংলাদেশে এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮শ ৩৮ জন (১৭ এপ্রিল পর্যন্ত)। প্রাণ ঝরে গেছে ৭৫ জনের। সারাবিশ্বে এই মৃতের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি।
আমি সারাদেশের মতো আমার সিলেট অঞ্চল নিয়েও উৎকণ্ঠিত। ইতোমধ্যে এই অঞ্চলে আক্রান্তের তালিকা হয়ে গেছে ৮ জনে। প্রাণ ঝরে গেছে একজন স্বনামধন্য চিকিৎসকের। এর আগে প্রাণ গেছে মৌলভীবাজারে এক মুদি দোকানীর। বাকি ৬ জন পাঞ্জা লড়ছেন মৃত্যুর সাথে। নমুনা পরীক্ষায় পর রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছেন আরো ১৩ জন। এই অবস্থার মধ্য দিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সিলেটের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। ২ টি ভ্যন্টিলেটর করোনা চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নয়, এমনটি বলার পর সিলেটে যুক্ত হয়েছে আরো ৯ টি ভেন্টিলেটরসহ আইসিউ বেড। প্রশ্ন হচ্ছে-যে দুটি ভেন্টিলেটর ছিলো-সেগুলো কার্যকর ছিলো তো ? অন্তত একজন ডা. মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর পর এই বিষয়টির আলোচনা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। এই প্রসঙ্গে পরবর্তী লেখনীতে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
প্রথমত, অনেক হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট নেই। নেই ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। প্রকৃতপক্ষে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় হযবরল অবস্থা চলছে। একদিকে করোনার চিকিৎসা নিয়ে দুর্ভোগ, অন্যদিকে করোনার চিকিৎসা করতে গিয়ে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা হচ্ছে না ঠিকমতো। করোনা ছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, চিকিৎসাসেবা না পেয়ে তারা হাসপাতাল ছাড়ছেন। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বন্ধ রেখেছেন প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা। অনেক রোগী এ হাসপাতাল, সে হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন বলেও খবর রয়েছে।
দ্বিতিয়ত , করোনা আতঙ্কে চিকিৎসক ও নার্সদের একটি বড় অংশ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) স্বল্পতা এবং সাধারণ রোগীরা যে করোনা আক্রান্ত নন, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই মূলত চিকিৎসাব্যবস্থায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দীনের দুঃখজনক মৃত্যুও আমাদের চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার দিকটিকে উন্মোচিত করেছে। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় চিকিৎসক ও নার্সদের যথাযথ প্রশিক্ষণেরও অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তৃতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক তদারকির অভাব। এই বিষয়ে এই মুহুর্তে আলোচনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুনামগঞ্জে দুই করোনা আক্রান্ত মহিলার বিষয় দিয়েই আলোচনা স্পস্ট করতে চাই। সুনামগঞ্জে প্রথম আক্রান্ত মহিলার বাড়ি দোয়ারাবাজার উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামে। ওই মহিলা আক্রান্তের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানালেন ওই মহিলার স্বামী বিদেশ ফেরত। স্বামী থেকেই সংক্রমন হয়ে থাকতে পারে। বিদেশ ফেরত জানার পরও উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা কেনো তাকে কোয়ারেন্টিন করেননি এবং কেনো ওই প্রবাসীর শরীরের নমুনা তাৎক্ষনিক সংগ্রহের ব্যবস্থা করেননি-এই বিষয়টি এখন আলোচনার দরকার। মহিলা আক্রান্তের পর কেনো মহিলার প্রবাসী স্বামীর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলো ?
প্রথম অংশে করোনাকালে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দৈন্যদশা ফোটে উঠেছে এবং দ্বিতীয় অংশে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের ঝুঁকি, অনিহা এবং অদক্ষতার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
তৃতীয় প্রশ্নের আরো একটি সম্পুরক প্রশ্ন হলো-আক্রান্ত মহিলার প্রবাসী স্বামীর তথ্য ইউনিয়ন পরিষদের স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য জানার পর তিনি কতোটুকু ভুমিকা পালন করেছিলেন ? চেয়ারম্যান সাহেবের নিকট কি এই তথ্য অজানা ছিলো ?
সুনামগঞ্জে ২য় করোনা আক্রান্তও একজন মহিলা। মহিলার বাড়ি সদর উপজেলায়। আক্রান্তের পর ওই মহিলার স্বামীর উপরেও অভিযোগ আসে একইভাবে । বিভাগীয় স্বাস্থ অফিসের সহকারি পরিচালক, সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন, ইউএইচও, ইউএনও সবার বক্তব্য-ওই মহিলার স্বামী ২০ দিন আগে নারায়নগঞ্জ থেকে বাড়ি আসেন। তিনিই সংক্রমন বহন করছিলেন। কিন্তু না। সত্যতা মিলেনি এই বক্তব্যের। মহিলা আক্রান্তের পর স্বামীর শরীরের টেস্ট গ্রহণ করা হলেও রিপোর্ট আসে নেগেটিভ।
এখন প্রশ্ন-যদি মহিলার স্বামী নারায়নগঞ্জ থেকে এসেই থাকেন, তাহলে তাঁর বাড়িতে বিপজ্জনক লাল নিশান কেনো টাঙ্গানো হলোনা ? সংশ্লিষ্টরা কেনো মহিলার স্বামীর হোমকোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেননি ? তাছাড়া, মহিলার শরীরে করোনার উপসর্গ ছিলোনা, তিনি এসেছিলেন গর্ভবতী হয়ে। ৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল থেকে তিনি সিলেট ওসমানী হাসাপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে ৩ দিন অবস্থান করার পর মহিলার শরীরে ১১ এপ্রিল দেখা দেয় করোনার উপসর্গ। অতপর টেস্ট রিপোর্ট গ্রহণের পর ১২ এপ্রিল মহিলার শরীরে করোনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
এর মধ্যে কোনটিকে আমরা সত্য ধরে নেবো ? স্বামী থেকে নাকি ওসমানী হাসপাতাল থেকে তিনি সংক্রামিত হয়েছিলেন ? এই উত্তর খোঁজে না পেলে সামনে বিপদ আসবে আরো ভয়াবহ।
এবার যাওয়া যাক আমাদের দায়বোধ বিষয়ে। আমরা সবাই জানি, করোনা থেকে বাঁচতে হলে সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের কথা। ভাইরাসটি প্রতিরোধ করার কোনো কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার হয়নি। এছাড়া আমরা যখন দেখি বিশ্বের উন্নত দেশগুলো প্রতিনিয়ত কাবু হয়ে যাচ্ছে করোনাভাইরাসে তখন আতঙ্কগ্রস্ত হই। যখন দেখি বাংলাদেশে টেস্টের পরিমাণ যত বাড়ছে ততই ভাইরাস আক্রান্তের পরিমাণ বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ি স্বাভাবিকভাবে। অথবা যখন শুনি সংস্পর্শ থেকে ভাইরাসটি দ্র“ত ছড়ায় তখন মনে সন্দেহ দানাবাঁধে।
কিš‘ এভাবে আতঙ্ক ও মন দুর্বল করা সন্দেহকে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা নিজেদের ভেতরে থাকা সুরক্ষাশক্তি বিনষ্ট করছি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। আমরা জানি, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অন্তর্গত কিছু ক্ষমতা মানুষ সৃষ্টিকর্তার দয়ায় পাই। সেই ক্ষমতার ধার কমিয়ে দেয় আতঙ্ক ও হতাশা। সুতরাং আমাদের সতর্ক ও সচেতন থেকে ধৈর্য্যধারণ করে সংকট মোকাবিলা করতে হবে। খাদ্য ও জীবনাচারের মাধ্যমে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে মনকে সন্দেহমুক্ত রেখে জীবন পরিচালনা করলে সমস্যা অনেক কমে আসবে।
করোনা আক্রান্ত হলে কোনো না কোনোভাবে শরীর সেটা জানান দেবে। কিš‘ আক্রান্ত না হয়েও যদি সবসময় সন্দেহে ভুগতে থাকি তাহলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমাদের কাজ হবে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থাসহ দেশীয় চিকিৎসকরা যে নির্দেশনা দেন, তা মেনে চলা। বাকিটুকু ছেড়ে দেই না কেন সৃষ্টিকর্তার ওপর। কারণ তিনিই তো জানেন আমাদের জন্য ভালো কোনটি।
সময় গড়িয়েছে অনেক। এর ভয়ানক ফলাফল দেখার কেবল অপেক্ষা। যেটুকু সময় এখনো আছে, সেই সময়টিতে লকডাউন নির্দেশিকা মেনে চলা, চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্কট বিষয়টি কাটিয়ে তোলা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে উপজেলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আরো বেশি তৎপরতার মধ্য নিয়েই ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব।
(লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক)
নির্বাহী সম্পাদক