বিশেষ প্রতিবেদন: নীরাকে নিয়ে বহু কবিতা লিখলেও স্বাতীর প্রতি সুনীলের প্রেম চিরস্মরণীয়। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই বলেছে, ‘আমি নীরা নই, আমি সুনীলের স্বাতী’। কম বয়সে স্বাতীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বহরমপুরে কোনও এক অনুষ্ঠানে গিয়ে সেখান থেকে স্বাতীকে চিঠিও লিখেছিলেন তিনি। হ্যাঁ প্রেমপত্র! আর প্রেমে পড়লে যে মন ভাল থাকে সেকথাও লিখতে ভোলেননি সুনীল।
১৯৬৬ সালের ২২ জুন বহরমপুর থেকে যে প্রেমপত্র লিখেছিলেন সুনীল তাঁর শুরু হয়েছে এইভাবে, “মনটা কী চমৎকার হালকা হয়ে গেছে আমার, কী যে ভালো লাগছে আজ। যে-কথাটা বলার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে ঘুরেছি এ ক’দিন, অথচ মুখ ফুটে বলতে পারিনি, বলার সাহস হয়নি, সেদিন সন্ধ্যেবেলা যখন হঠাৎ বলে ফেললুম, হাঁটুর উপর মুখ রেখে তুমি যখন আস্তে বললে ‘হ্যা’, সেই মুহূর্তে আমার জীবনটা বদলে গেল। আমি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই– তোমাকে হারাবার ক্ষতি কিছুতে আমি সহ্য করতে পারবো না– এই কথাটা প্রবলভাবে দাবি করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু ভয় ছিল যদি এ আমার স্বার্থপরতা হয়, তাছাড়া, আমি তোমাকে চাই, তুমি যদি আমাকে না চাও? সত্যিই, স্বাতী, সত্যিই তুমি আমার হবে, এবং আমি তোমার হব? আমি তো তোমার হয়েই আছি।”
বোঝাই যাচ্ছে স্বাতীর প্রেমে কতটা মগ্ন হয়েছিলেন সুনীল। প্রেমে পড়লে যেমনটা হয়, নিজের কথা ভালবাসার মানুষকে জানানোর আকুতি। সুনীল লিখেছেন, “তুমি আমার সম্পর্কে হয়তো অনেক কিছুই জানো না, আমি নানা রকম ভাবে জীবন কাটিয়েছি, অনেক ভুল এবং হঠকারিতা করেছি, কিন্তু কখনো কোনো অন্যায় করিনি, আমি গ্লানিহীন, আমার স্বভাবে কোনও দোষ নেই- এ কথা তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে। আমি এ পর্যন্ত তোমার কাছে একটিও মিথ্যে কথা বলিনি, ভবিষ্যতেও তুমি যা জিজ্ঞেস করবে তার কোনো মিথ্যে উত্তর দেবো না।”
তরুণ বয়সে সুনীল স্বাতীকে বলেছিলেন আমি তোমার যোগ্য নই! অথচ স্বাতী কিন্তু সুনীলের লেখা পড়েই তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিলেন। সুনীল সেই প্রেমপত্রে লিখেছেন, “আমি তোমার যোগ্য নই, কিন্তু ক্রমঃশ যোগ্য হয়ে উঠতে পারি, হতে শুরু করেছি, তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই আমার নিজের মধ্যে একটা পবিত্রতার স্পর্শ ও বোধ পেয়েছি। তুমি আমার জীবনকে স্নিগ্ধ করে দিতে পারো। আমি তোমাকে জানি। আমি তোমাকে দেখেই তোমাকে সম্পূর্ন জেনেছি। মানুষ চিনতে আমার কখনো ভুল হয় না, আমার চোখের দৃষ্টি কত তীক্ষ্ম তুমি জানো না। আমি তোমাকে দেখেই জেনেছি-– তোমার এমন অনেক দূর্লভ গুণ আছে – যা তুমি নিজেই জানো না। তুমি কি সত্যিই আমাকে গ্রহণ করবে?”
তখনও সুনীলের মধ্যে কাজ করেছিল দোলাচলতা। সুনীল লেখালিখির জীবনের ভয়াবহতার কথা জানতেন। সে জন্যই বোধ হয় স্বাতীর উদ্দেশ্যে চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাকে গ্রহণ করলে তোমাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কিন্তু তোমাকে পেলে আমার কিছুই হারাবার নেই-– বরং, আমি অশেষ সৌভাগ্যবান হব। তুমি কি আমার জন্য সেসব ত্যাগ স্বীকার করতে চাও? পারবে, তোমার এতদিনের চেনা পরিবেশ ছেড়ে আসতে? তোমাদের বাড়ি খুব সম্ভব আমাকে স্বীকার করবে না। আমার তো কোনো চালচুলো নেই। আমি বিদেশে গিয়েছিলুম – এটা কারুর কারুর কাছে হয়তো সম্মানের বা ঈর্ষার হতে পারে – কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে তার তো কোনো মূল্যই নেই।”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তরুণ লেখক হিসেবে আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে বেকার হয়ে পড়েন। নানা উৎকণ্ঠাই তাঁর লেখা চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে। যা এখনও নতুন প্রেমিক-প্রেমিকাদের উজ্জীবিত করে। পরে অবশ্য স্বাতীকেই বিয়ে করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমৃত্যু স্বাতীর সঙ্গে ঘর করেন সুনীল।
নির্বাহী সম্পাদক