বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘ব্যাংক মালিকদের চাপে’ নগদ-জমার বাধ্যবাধকতা (সিআরআর) শিথিল করার পাশাপাশি রেপোর সুদহার কমানোর যে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে, তা তাদের মুদ্রানীতির সঙ্গেই সাংঘর্ষিক।
এসব পদক্ষেপ ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতা দূর করার বদলে উল্টো অরাজকতা বৃদ্ধি করবে বলে সরকারকে সতর্ক করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী অবশ্য চাপের কথা অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হিসেবেই এসব পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছে।
সরকার এমন এক সময়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছে, যখন শত শত কোটি টাকা অনিয়মের কারণে মাত্র চার বছর আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠিত ফারমার্স ব্যাংককে ধুঁকতে হচ্ছে। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটের মূল কারণ ভোটের আগে অর্থ পাচার কি না, সে প্রশ্নও ইতোমধ্যে উঠেছে।
আর গত রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা-মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক বসেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও গভর্নর ফজলে কবির যেভাবে সিআরআর ও রেপো হার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওইভাবে তা করতে পারে কি না, তা নিয়েও গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।
রোববারের ওই বৈঠকের পর বিএবির সদস্যরা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সপরিবারে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আসেন।
গণভবনে মঙ্গলবার ব্যাংক মালিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; ওই অনুষ্ঠানে আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন হয়
মঙ্গলবারই প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যাংকগুলোর আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমার বাধ্যবাধকতা ১ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা ১৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
এতদিন সব ব্যাংককে তাদের গ্রাহকদের আমানত হিসেবে পাওয়া অর্থের সাড়ে ৬ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা (সিআরআর) রাখতে হত। নির্দিষ্ট সময় পরপর জমার পরিমাণ হিসাব করা হত; নগদ জমার পরিমাণ কম হলে দিতে হত জরিমানা। এখন ওই হার কমিয়ে আনা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশে।
ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। ব্যাংকগুলো যাতে কম খরচে ধার পায়, সেজন্য রেপোর হার কমিয়ে আনা হয়েছে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট।
এতদিন রেপোর ক্ষেত্রে সুদহার ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তা কমিয়ে ৬ শতাংশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে এখন ব্যাংকগুলোর খরচ কমবে।
আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। সেই সুদহার আগের মতই ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থাকছে।
রেপোকে বলা হয় ব্যাংকিং খাতের নীতি উপাদান (পলিসি টুলস)। এর সুদ হারকে বলা হয় নীতি সুদ হার (পলিসি রেট)। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে।
আর রিভার্স রেপোর সুদ হার কমালে বুঝতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইছে ব্যাংকগুলো টাকা ফেলে রেখে মুনাফা না তুলে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়াক।
বর্তমানে রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করলে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সাত দিন রাখতে পারে। এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রেপো হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানো হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআরকে ব্যবহার করে ব্যাংকের আমানতকারীদের রক্ষাকবচ হিসেবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পলিসি টুলস ব্যবহার করে। এ উদ্দেশ্যেই ২০১৪ সালে বর্তমান সরকার টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সিআরআর ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়।
সিআরআর ও রেপো হার কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ পাওয়া আরও সহজ করেছে। কেবল সিআরআর কমানোর ফলেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা যাবে বলে অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য।
এর বাইরে সরকারি তহবিলের অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার সুযোগও বাড়ানো হয়েছে, যাতে আরও বেশি তহবিল পাবেন ব্যাংকাররা।
সরকারি সংস্থাগুলো এতদিন তাদের তহবিলের ৭৫ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এবং বাকি ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখত। সরকার ঠিক করেছে, এখন থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ৫০ শতাংশ রাখা হলে বাকি ৫০ শতাংশ রাখা হবে বেসরকারি ব্যাংকে।
ফারমার্স ব্যাংক নিয়ে জটিলতার অবসান হওয়ার আগেই সরকারের এমন সিদ্ধন্ত বিস্মিত করেছে অর্থনীতির বিশ্লেষকদের।
সরকারের জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রায় ৫০৮ কোটি টাকা আমানত হিসেবে রাখা হয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ফারমার্স ব্যাংকে। অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে তা আদায় করতে না পারায় ওই ব্যাংক এখন গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ফলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু তহবিলের আমানতের টাকাও আটকে গেছে।
ফারমার্স ব্যাংকের মত কিছু বেসরকারি ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিং করে নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি হারে ঋণ দেওয়ায় আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কায় গত জানুয়ারিতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণে লাগাম টানার চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সাধারণ ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) ৮৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৯ শতাংশ করা হয়।
এর অর্থ হল, সাধারণ ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সার বেশি ঋণ বিতরণ করতে পারবে না। আর ইসলামী ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করলে ৮৯ টাকা ঋণ দিতে পারবে।
যেসব ব্যাংক এই সীমার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে, তাদের ৩০ জুনের মধ্যে তা সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল সে সময়। কিন্তু ঋণ-আমানত অনুপাত সমন্বয় আনতে অনেক ব্যাংক তখন চড়া সুদে আমানত সংগ্রহ শুরু করে।
ফলে তৈরি হয় নতুন অস্থিরতা, যার প্রভাবে পুঁজিবাজারে টানা ধস চলতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে ব্যাংকগুলোকে পুরো ২০১৮ সাল সময় দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বেসিসেবি ঋণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই পদক্ষেপ অর্থহীন হয়ে পড়ছে সিআরআর ও রেপো হার কমানোর কারণে।
“একটা হোটেলে বসে মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ দুটি হাতিয়ার সিআরআর ও রেপো সুদহার কমানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এটা মুদ্রানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংযত মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সিআরআর ও রেপো সুদহার কমানোর কারণে বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়বে; সেই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি।
“টাকার সরবরাহ বাড়ায় ব্যাংকগুলো বাছ-বিচার না করে যাকে তাকে ঋণ দেবে। বেড়ে যাবে খেলাপি ঋণ। সঙ্কট আরও বাড়বে।”
সাবেক এই গভর্নরের বিশ্বাস, ব্যাংকগুলোর তারল্য যতট খারাপ অবস্থায় আছে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি আসলে ততটা খারাপ নয়।
“দুই একটি ব্যাংকের লিকুইডিটির অবস্থা খারাপ। সেগুলোর জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যেত। ঢালাওভাবে সব ব্যাংকের জন্য সিআরআর, রেপো সুদহার কমানো উচিৎ হয়নি।”
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক মালিকদের চাপেই যে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটা ‘পরিষ্কার বোঝা যায়’।
“কিছুদিন আগেই তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি ঘোষণা করল, তখন সিআরআর, রেপো সুদহার কমানোর প্রয়োজন হলে কমাতো। এখন ব্যাংক মালিকদের চাপে এটা করা মোটেই সমীচীন হয়নি।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে বুধবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেম।
এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “ওই দুই সিদ্ধান্ত সঠিক উপায়ে নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি মেকিংয়ের ইউনিট আছে, তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে, এখানে আমরা তা দেখিনি… আশ্চর্যের বিষয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোর দাবির মুখে।”
এতে পুরো আর্থিক খাতে ‘ভুল সংকেত’ যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে ব্যাংকগুলো এখন খারাপ পারফর্ম করছে তাদের কাছে যদি আবার টাকা দেওয়া হয়, সেই টাকারও অপব্যবহার হবে কিনা- সে নিশ্চয়তা তো নেই।”
সেলিম রায়হানের আশঙ্কা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘দুর্বল নিয়ন্ত্রণ’ এর কারণে ঋণ খেলাপিদের শাস্তি না হওয়ায় অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ আগামীতে আরও বাড়বে।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র দেবাশীষ চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই প্রশ্ন কেন উঠছে সেটা আমি বুঝতে পারছি না।”
“সরকার ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হিসেবেই সিআরআর এবং রেপো সুদ হার কমানো হয়েছে। অন্য কোনো কারণে বা চাপে নয়।”
তিনি বলেন, সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একে অপরের পরিপূরক।
“সরকার রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছে, সেটা বাস্তাবে রূপ দেওয়ার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”
নির্বাহী সম্পাদক