সঞ্চয়পত্রের লাগাম টানতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরইমধ্যে চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া, এক লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই ব্যক্তির একাধিক জায়গা থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা ঠেকাতেও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। একজন সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এতে সঞ্চয়পত্র-ক্রেতাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অনেকেই সঞ্চয়পত্র নিয়ে সরকারের উদ্যোগের সমালোচনাও করেছেন।
তবে, সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। কারণ, যে কেউ ইচ্ছে করলে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। যিনি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন, তিনি তো অনেক ধনী। কাজেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ক্রেতাদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করায় সমস্যা হচ্ছে তাদের, যারা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতেন আগে। এতে সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য কোনও সমস্যা হচ্ছে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘এর আগে কালো টাকাও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হতো। এ কারণে সরকারের সুদ ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।’
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা ব্যক্তিদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরগুলো এখন মিলিয়ে দেখা দরকার। কারণ, অনেকেই হয়তো এক পরিচয়পত্র দিয়ে দুই বা তিন ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনে সরকারের ব্যয় বাড়াচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘যারা সঞ্চয়পত্রকে ঝামেলা মনে করবেন, তারা ইচ্ছে করলে ব্যাংকে টাকা রাখতে পারেন। এছাড়া অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও টাকা রাখতে পারেন।’
প্রসঙ্গত, সরকারকে সঞ্চয়পত্র খাতে ব্যয় কমানোর জন্য অর্থনীতিবিদরা গত কয়েকবছর ধরে পরামর্শ দিয়ে এলেও ব্যয় বেড়েই চলছিল।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য বলছে, প্রতি বছরই সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র খাতে সুদ-আসল পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা ছিল ৩৮ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সুদ-আসল পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে ১৩ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই খাতে খরচ হয় ২০ হাজার ২৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের খরচ হয়েছে ২২ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে।
মূলত, বাজেট ঘাটতি পূরণে প্রতিবছরই দুইভাবে ঋণ নিয়ে থাকে সরকার। এর একটি বৈদেশিক সহায়তা, অন্যটি অভ্যন্তরীণ উৎস। অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এই অর্থবছরে সরকারের ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
গত অর্থবছরের মূল বাজেটে এই খাত থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রে ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অবশ্য এই অর্থবছরে সরকারের নেওয়া উদ্যোগের ফল পাওয়া শুরু করেছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতর। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) ৩ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই ও আগস্ট) বিক্রি হয়েছিল ৯ হাজার ৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। আর আগের বছরের আগস্ট মাসের চেয়ে এই বছরের আগস্টে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমে এসেছে। এই আগস্ট মাসে ২ হাজার ২০৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আগের বছরের (২০১৮) আগস্ট মাসে ৪ হাজার ২১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। গত জুলাই মাসে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আগের বছরের (২০১৮) জুলাই মাসে হয়েছিল ৫ হাজার ৩৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি।
এদিকে, টিআইএন বাধ্যতামূলক করায় অনেকেই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না বলে জানান ক্রেতা রনজিত সরকার। তিনি বলেন, ‘আগের মতো যে কেউ যে কোনও পরিমাণ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না। টিআইএন থাকলেও ৬০ লাখ টাকার ওপরে বেশি কেউ কিনতে পারছেন না। ফলে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।’
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘নারী ও স্বল্প আয়ের মানুষদের আটকানো সরকারের উদ্দেশ্য নয়। এই খাতে অনেকেই অপ্রদর্শিত কিংবা কালো টাকা বিনিয়োগ করে আসছিলেন। এখন তা বন্ধ হয়েছে। এছাড়া অনেকে নামে-বেনামে ডাকঘর, সঞ্চয় অফিস ও ব্যাংকের মাধ্যমে আলাদাভাবে সঞ্চয়পত্র কিনতেন। এতে তারা সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে কোটি কোটি টাকারও বেশি এই খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা নিতেন। এটি ঠেকানোর জন্যই সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে।’
উল্লেখ্য, বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের চালু করা চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এগুলো হলো, পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। এগুলোর গড় সুদের হার ১১ শতাংশের বেশি।
বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রে একজন ব্যক্তি একক নামে সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকা এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রে এ সীমা ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। তিনমাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা যৌথ নামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। পরিবার বা পেনশনার সঞ্চয়পত্র যুগ্মনামে কেনার সুযোগ নেই। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা এবং যুগ্মনামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখা অফিস, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্ধারিত শাখা, জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো অফিস ও পোস্ট অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা যায়।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন
বার্তা বিভাগ প্রধান