গাজীপুর সিটি করপোরেশনের টঙ্গীতে জাতীয় মহাসড়কে দুই থেকে তিনজনের একাধিক দল চোখে পড়ে। শেওলা রঙের ইউনিফর্ম তাঁদের পরনে। গায়ে কমলা রঙের হাফ-জ্যাকেট। পিঠে লেখা, ‘জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন ট্রাফিক সহকারী’। হাতে একটি লাঠি নিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন এসব ট্রাফিক সহকারী। গত ডিসেম্বর মাস থেকে এমন ৩২০ জন সহকারী সড়কে আছেন। স্থানীয় কয়েক শ্রমিক বললেন, ভয়াবহ যানজটে কিছুটা গতি দিয়েছে এসব সহকারীর তৎপরতা। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ মো. জাহাঙ্গীর আলম তাঁর নামে তৈরি শিক্ষা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এসব কর্মী পাঠিয়েছেন। এসব কর্মীর ন্যূনতম বেতন ১০ হাজার টাকা। একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এসব কর্মীকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানালেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন চান। আগামী ১৫ মে অনুষ্ঠেয় গাজীপুর সিটির নির্বাচনে আরেক শক্ত প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান। দলীয় নেতা জাহাঙ্গীরের এই সড়ক-পরিষেবার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘এসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে লোক-দেখানো উদ্যোগ।’
জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, এই সড়ক-পরিসেবায় তাঁর প্রতিমাসে খরচ হয় ৫০ লাখ টাকার বেশি। অর্থাৎ গত চার মাসে তিনি দু কোটি টাকার ওপর খরচ করেছেন। কিন্তু মেয়র প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন না পেলে বা মনোনয়ন পাওয়ার পরও না জিতলে এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যতদিন সম্ভব হবে ততদিন তিনি এই কাজ চালিয়ে যাবেন।
গত শনিবার গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ঢাকা-লাগোয়া গাজীপুরে অবশ্য শাসক দলের এই দুই নেতার প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই চলছে। তুরাগ পার হওয়ার আগে উত্তরা নয় নম্বর সেক্টরেই চোখে পড়ে শাসক দলের কয়েকজন নেতার মেয়র পদে প্রার্থিতার পোস্টার। ‘উৎসাহী’ সমর্থকদের নামে ছাপানো এসব পোস্টারের মধ্যে আজমত উল্লাহ এবং জাহাঙ্গীর আলমের পোস্টারের সংখ্যাই বেশি। বাস্তবে আলোচনায় এ দুজনই। নির্বাচনে কে জিতবেন—এমন আলোচনার চেয়ে শাসক দলের মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, তা নিয়েই এলাকায় আলোচনা বেশি। দুই নেতার মতোই বিভক্ত নেতা-কর্মীরা। কেউ কারও পক্ষে-বিপক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অধ্যাপক বলছিলেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবলে যদি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মধ্যে ফাইনাল হয়, তাহলে ফাইনালের আগেই ফাইনাল হয়ে যায়। গাজীপুরে ভোটের আগে বড় ভোট হচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে।’
সেই বড় ভোটে কে জয়ী হবেন? আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘আজীবন দলের হয়ে কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি। দলের দুঃসময়ে থেকেছি। তিনবার পৌর মেয়র ছিলাম। সিটি করপোরেশন চালানোর জন্য যে অভিজ্ঞতা দরকার, তা আমার আছে।’ যে বড় অভিজ্ঞার কথা আজমত উল্লাহ খান বললেন, তা যথার্থ। তিনি তিনবার টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান (পরে মেয়র) ছিলেন। পৌরসভার মেয়রদের জাতীয় সংগঠনের প্রধান ছিলেন। তাঁকে বলা হতো ‘মেয়রদের মেয়র’।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন হওয়ার পর প্রথম নির্বাচন হলো ২০১৩ সালে। সেই নির্বাচনে কিন্তু লক্ষাধিক ভোটে হারেন এই মেয়র-নেতা। এই বড় পরাজয় কেন? আজমত উল্লাহ বলেন, ‘সেই সময় ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল, তাতেই এই পরাজয় হয়েছিল। শুধু আমি তো না, আরও চার সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা হেরেছিলেন।’
আজমত উল্লাহর মতো এই বিশাল অভিজ্ঞতা কিন্তু জাহাঙ্গীর আলমের নেই। ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। ভাওয়াল বদরে আলম কলেজে ভিপি পদে প্রার্থী হয়ে ৭ ভোটে হেরেছিলেন। ২০০৯ সালে জীবনের প্রথম নির্বাচনে গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুই লাখ ৯৭ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে তাক লাগান সবাইকে। ওই নির্বাচনে সদরে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছিলেন মাত্র ৮৪ হাজার ভোট। জাহাঙ্গীর আবারও আলোচনায় আসেন ২০১৩ সালের মেয়র নির্বাচনের আগে। দল আজমত উল্লাহ খানকে মনোনয়ন দিলেও নাছোড় জাহাঙ্গীর মেয়র পদে দাঁড়ান। পরে হয় এক নাটক। জাহাঙ্গীরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দলের প্রবল চাপে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মনোনয়ন প্রত্যাহারের কথা জানান তিনি।
আজমত উল্লাহ খানের রাজত্বে এখন ৩৯ বছর বয়সী জাহাঙ্গীরের শক্তি কোথায়? স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, তৈরি পোশাকশিল্প ও প্যাকেজিং শিল্পের মালিক ধনাঢ্য জাহাঙ্গীর। অকাতরে অর্থ বিলান। আগেরবার দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ভগ্নমনোরথ হলেও জাহাঙ্গীর কিন্তু থেমে থাকেননি। এ পর্যন্ত ২২ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছেন। এ বছর ১০ কোটি টাকার বৃত্তি দিয়েছেন, জানান জাহাঙ্গীর। ১০০টি ল্যাপটপ দিয়েছেন, নিজ খরচে বিদেশে পর্যন্ত পাঠিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থীকে। আজমত উল্লাহ খানের অবশ্য বক্তব্য, ‘কজন আসলে বৃত্তি পেয়েছে, এটা খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার।’ জাহাঙ্গীরের আর্থিক সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যার বিচার না করা গেলেও তিনি যে যথেষ্ট সাহায্য করেন, তা নিয়ে দলীয় কর্মীদের কিন্তু তেমন দ্বিমত নেই। টঙ্গীর বাসিন্দা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক এক নেতা বললেন, ‘অর্থ তো অনেকেরই আছে। কজন এত খরচ করে?’ খরচের পাশাপাশি নিজের এক বলয় তৈরি করে ফেলেছেন জাহাঙ্গীর। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি থাকলেও ৫৭টি ওয়ার্ড কমিটি-শূন্য। এসব ওয়ার্ডে সক্রিয় ‘জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন’। দলীয় লোক, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, নারী—এই চার ক্যাটাগরিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীরের নিজস্ব একটি কমিটি আছে। অনেকেই এদের ‘জাহাঙ্গীর লীগের’ সদস্য বলে থাকেন।
দলের বাইরে এভাবে ওয়ার্ডভিত্তিক নিজস্ব কমিটি যে জাহাঙ্গীরের আছে, তা জানেন আজমত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘দলকে বিভাজনের জন্যই এ কাজ করা হয়েছে।’ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আজমত-জাহাঙ্গীরের ভাগ হওয়া সমর্থকদের মধ্যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়েছে। টঙ্গীতে আজমত-সমর্থকদের সংখ্যা বেশি। গাজীপুর সদর উপজেলায় বেশি জাহাঙ্গীরের সমর্থক। জাহাঙ্গীরের জনপ্রিয়তা বেশি অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে। পুরোনো আওয়ামী লীগারদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় আজমত। টঙ্গীর বোর্ড বাজারের বাসিন্দা সাদেকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আজমত উল্লাহ সাহেব বর্ষীয়ান নেতা। দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা জাহাঙ্গীরের তুলনায় বেশি। তবে জাহাঙ্গীরের দলের বাইরেও একটি ভিন্ন জগৎ আছে। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাইরে হেফাজত, চরমোনাই-সমর্থক, এমনকি বিএনপির একটি অংশের ভোট পাবেন। এসব ভোট তাঁর নিজস্ব ভোট।’
গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের ‘দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ’ বলা হয়। এ জেলা সব সময় দলটির পক্ষে থেকেছে। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভয়াবহ ভরাডুবির সময় জেলার চারটি আসনের তিনটিই আওয়ামী লীগ পেয়েছিল। একটি আসনে সামান্য ভোটে হেরেছিলেন দলীয় প্রার্থী আকতারুজ্জামান। জেলার গাজীপুর পৌরসভা এবং টঙ্গী পৌরসভাও দীর্ঘ সময় ছিল আওয়ামী লীগের দখলে। দলীয় নেতা রহমত আলী, এখন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আজমত উল্লাহ খান—এসব নাম দলটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এসব নেতা এখনো সক্রিয়। জেলায় আওয়ামী লীগের শক্ত সাংগঠনিক ভিত গড়তে বর্ষীয়ান এসব নেতার অবদান দলীয় নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধার সঙ্গেই মনে রেখেছেন। ওয়ার্ডের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের এক নেতা বলছিলেন, ‘অর্থশক্তি যে দেশের রাজনীতির বড় নিয়ামক হয়ে গেছে, জাহাঙ্গীর তার প্রমাণ। দলের প্রতি আনুগত্য, লেগে থাকার মতো অসম্ভব গুণই ছিল এখানকার নেতাদের যোগ্যতা। এখন তা নেই।’
অবশ্য এর ভিন্ন বক্তব্যও আছে। কেউ কেউ বলছেন, বয়স্ক নেতাদের ভিড়ে জাহাঙ্গীর আলম একেবারে নবীন। তাঁকে স্থানীয় নেতৃত্ব তাই খুব ভালোভাবে নিচ্ছে না, এমন মন্তব্য জেলার যুবলীগের এক নেতার। তিনি বলেন, ‘নেতাদের এক মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি হয়েছে।’ আ ক ম মোজাম্মেল অবশ্য এমন অভিযোগ অগ্রাহ্য করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবীন-প্রবীণ মিলে দল চলবে। নতুন কেউ এলে সমস্যা হবে কেন?’ গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হারলেও সিটির বেশির ভাগ কাউন্সিলর কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসব কাউন্সিলরের ভেতরে আজমত উল্লাহর জনপ্রিয়তা বেশি। স্থানীয় নেতাদের কাছেও তিনি জনপ্রিয়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র এবং এখনকার কাউন্সিলর মো. আসাদুর রহমান কিরণ অকপটে আজমত উল্লাহর প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানালেন। বললেন, ‘আজমত ভাইয়ের বিকল্প এখনো আমাদের কাছে নেই।’ কিরণ নিজেও মেয়র প্রার্থী। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর জন্যই তিনি কাজ করবেন বলে জানালেন।
এই একটি বিষয় কিন্তু দেখা গেছে আওয়ামী লীগ-সমর্থক এবং সেই সঙ্গে আজমত-সমর্থকদের মধ্যে। এঁদের অনেকেই বলেছেন, পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না পেলেও তাঁরা মনঃকষ্টে হলেও ভোট দেবেন দলীয় প্রার্থীকেই। টঙ্গীর তিস্তাপাড়ের চায়ের দোকানি বরাত মিয়া। সিটির নির্বাচনে আজমত উল্লাহকে চান একান্তভাবে। তিনি বলছিলেন, ‘আজমত ভাই পাইলে খুশি হই। তয় নৌকা জাহাঙ্গীর পাইলে ভোট তো অন্য কোথাও দিমু না। তেনারেই দিতে অইব।’ আওয়ামী লীগের দলীয় এসব ভোটের সঙ্গে ‘জাহাঙ্গীর লীগের’ ভোট মিলে জাহাঙ্গীর আলমের পাল্লা যে ভারী, তা স্থানীয় অনেকেই বলছেন। এই বার্তা কি কেন্দ্রের কাছে পৌঁছেছে? জাহাঙ্গীর জানান, দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে গত ডিসেম্বর মাসে তিনি গিয়েছিলেন। তাঁর কথা, ‘গণভবনে গিয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করার পর তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন করার জন্য আমাকে মৌখিকভাবে বলে দিয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের একটি মনোনয়ন বোর্ড থাকে। সেই বোর্ডের সিদ্ধান্ত আসবে শিগগিরই। আমার বিশ্বাস, দল আমাকেই মনোনয়ন দেবে।’
জাহাঙ্গীর যেমন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার নিশ্চয়তার কথা বলেছেন, এমনটা অবশ্য বলেননি আজমত উল্লাহ। বরং জাহাঙ্গীরের এই বক্তব্যকে দাবি উল্লেখ করে বলেন, ‘উনি কখনো বলছেন ডিসেম্বরে গেছেন, কখনো বলছেন জানুয়ারিতে গেছেন। দলের কাজ করার জন্য তো নেত্রী নির্দেশ দিতেই পারেন। তিনি হয়তো এমন নির্দেশেই এই মানে করেছেন।’ আজমত উল্লাহর বিশ্বাস, দল তাঁকেই মনোনয়ন দেবে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলছিলেন, ‘৮ এপ্রিল বোর্ড বসবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। সেই পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে।’
নির্বাহী সম্পাদক